কৃষক আন্দোলনে উত্তাল রাজধানী। ছবি: এএনআই।
প্রতিশ্রুতি মিলেছে ভুরিভুরি। অথচ দাবিদাওয়া পূরণ হয়নি আজও। বাধ্য হয়ে রাজধানীতে দু’দিন ব্যাপী আন্দোলনে নামলেন ২০০ সংগঠনের প্রায় ১ লক্ষ কৃষক। বৃহস্পতিবার সকালে পায়ে হেঁটে প্রথমে আনন্দ বিহার রেল স্টেশনে পৌঁছন আন্দোলনকারীরা। সেখানে তাঁদের স্বাগত জানান বাম সমর্থিত ছাত্র সংগঠন আইসা। তার পর সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লি হয়ে রামলীলা ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তাঁরা। তাতে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিজবাসন এবং দ্বারকা সংলগ্ন এলাকার যান চলাচল। তবে আপাতত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ নেই। কারণ সন্ধ্যায় রামলীলা ময়দানে বিরাট সভার আয়োজন হয়েছে। আন্দোলন চলবে শুক্রবারও। রামলীলা ময়দান থেকে সরাসরি সংসদভবনের উদ্দেশে রওনা দেবেন কৃষকরা। এই নিয়ে গত কয়েকমাসে তৃতীয়বার কৃষক আন্দোলনের সাক্ষী হচ্ছেন দিল্লিবাসী। তবে এর আগে এত বড় আন্দোলন হয়নি।
বিভিন্ন বামপন্থী কৃষক সংগঠনকে নিয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে ‘অল ইন্ডিয়া কিষাণ সঙ্ঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি’ গড়ে ওঠে। ঋণ মকুব এবং ফসলের ন্যায্য দাম-সহ মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্যের কৃষকদের সমস্যাগুলি তুলে ধরাই তাদের মূল লক্ষ্য। এ বারে তাঁদের দাবি, কৃষকদের ঋণ মকুব এবং ফসলের ন্যায্য দাম নিয়ে সংসদে তিন সপ্তাহের বিশেষ অধিবেশন বসুক। গড়ে তোলা হোক জাতীয় কৃষি ঋণ মকুব কমিশন। এ ব্যাপারে উদ্যোগী হোন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসদে বিল পাস করানো হোক।
সংগঠনের আহ্বায়ক সদস্য এবং সিপিএম সদস্য হান্নান মোল্লা জানান, ‘‘মঞ্জু কা টিলা এবং নিজামউদ্দিন থেকে রামলীলা ময়দানে কিষাণ মুক্তি মোর্চায় যোগ দেবেন আরও কৃষক। সন্ধেয় সেখানে বিশেষ এক শাম কিষাণ কে নাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। তাতে যোগ দেবেন বিভিন্ন গায়ক এবং কবি। ৩০ নভেম্বর রামলীলা ময়দান থেকে সরাসরি সংসদের উদ্দেশে রওনা দেব আমরা। পার্লামেন্ট স্ট্রিটে কৃষি সংক্রান্ত একাধিক সমস্যা নিয়ে বক্তৃতা করা হবে। বিজেপি ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বক্তৃতা করবেন।’’‘অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা’-র জাতীয় সম্পাদক অতুল অঞ্জন বলেন, ‘‘কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সব বিরোধী দলের অনেক নেতাকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’’
কেন্দ্র সরকারের উপর ক্ষুব্ধ কৃষকরা। ছবি: পিটিআই।
আরও পড়ুন: হাফিজ সইদের খালিস্তানি বন্ধুর সঙ্গে ছবি, পাকিস্তানে গিয়ে এ বারও বিতর্কে সিধু
ভারতে সবুজ বিপ্লবের জনক এমএস স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ২০০৪ সালের ১৮ নভেম্বর ‘ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মার্স’ (এনসিএফ) গড়ে তোলে তত্কালীন ইউপিএ সরকার। কৃষিজাত পণ্যের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তোলা, কৃষকদের ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়া এবং লাভজনক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই ওই কমিশনের লক্ষ্যে ছিল। সবকিছু খতিয়ে দেখে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে মোট পাঁচটি রিপোর্ট জমা দেয় তারা।
যার মধ্যে পঞ্চমটিকেই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মানেন বিশেষ়জ্ঞরা। কারণ তাতে বলা হয়,
ফসলের ন্যায্য দাম দিতে হবে কৃষকদের। যাতেছোট খাটো কৃষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কৃষিক্ষেত্রের সামগ্রিক উন্নতির জন্য জমি, জল, সার ও কীটনাশক, শস্য বিমার মতো প্রাথমিক জোগান কৃষকদের প্রাপ্য। বাজার এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে কৃষকদের। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সমস্ত জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, সেগুলিকে চাষযোগ্য করে কৃষকদের মধ্যে বিলি করে দিতে হবে। চাষযোগ্য জমিকে অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। সেচ ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে বিকল্প উপায়। সকলের কাছে তা পৌঁছচ্ছে কি না নিশ্চিত করতে হবে তাও। বৃষ্টির জল জমিয়ে তা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তুলতে হবে। কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার কমানোর পরামর্শও দেওয়া হয়। ঋণ মেটানোর ক্ষমতা না থাকলে কাউকে জোরাজুরি করা যাবে না। বরং যথেষ্ট সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে মকুব করে দিতে হবে ঋণ। কৃষিকাজে যুক্ত মহিলাদের জন্য বিশেষ কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের ব্যবস্থাও করতে বলা হয়।
আরও পড়ুন: মহাপ্রলয় আসন্ন? আট দশকেই জলমগ্ন হবে অধিকাংশ মহাদেশ: রাষ্ট্রপুঞ্জ
কৃষক আত্মহত্যা রুখতে কম টাকায় স্বাস্থ্য বিমার সুযোগ করে দিতে বলে স্বামীনাথন নেতৃত্বাধীন কমিশন। যাতে যত প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাই হোন না কেন, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সবরকম সুযোগ-সুবিধা পান কৃষকরা। দেনার দায়ে যাতে কাউকে আত্মহত্যা না করতে হয় তার জন্য বিশেষ মাইক্রো ফাইনান্স নীতি ঘোষণার সুপারিশ করা হয়। যাতে জমিতে উত্পাদিত ফসলের বিমা করাতে পারেন কৃষকরা। সেই সুবিধা পেলে কোনও কারণে ফসল নষ্ট হয়ে গেলেও সর্বস্বান্ত হতে হবে না কাউকে।
স্বামীনাথন কমিশনের এই সুপারিশগুলি কার্যকর করতে কেন্দ্রের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েছে কৃষক সংগঠনগুলি। কিন্তু এতদিনেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। তাই একবার ফের পথে নামতে বাধ্য হয়েছে তারা।