রাতারাতি জমি আইন সংশোধন করতে গিয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুধু হাতই পোড়ালেন না, সটান উল্টো পথে হাঁটা দিলেন, তখন জমি অধিগ্রহণে ব্যতিক্রমী নজির রাখলেন তাঁরই দক্ষিণী বন্ধু!
কোনও গাড়ি কারখানা বা পরিকাঠামো প্রকল্প নয়। নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে একটা আস্ত রাজধানী শহর গড়ে তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু। রাজ্য ভাগ হওয়ার পর অন্ধ্রপ্রদেশের নতুন রাজধানী হচ্ছে বিজয়ওয়াড়া-গুন্টুরের মাঝে। তার জন্যই বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করছে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। জায়গার পরিমাণও কম নয়। ৩৪ হাজার একর! এবং সে জায়গা কেমন? কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকায়, যেখানে জমি এতো উর্বর যে বছরে হেসেখেলে দু’টো তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে তার বেশিও ফসল ওঠে চাষির ঘরে! অথচ সেখানেই চন্দ্রবাবু এমন কৌশলে ৩৪ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে ফেললেন যে, বড় ধরনের কৃষক অসন্তোষ দূরস্থান, প্রতিবাদের বিশেষ খবরও বেরলো না রাজ্যের বাইরে!
অতীতেও কেন্দ্রে বাজপেয়ী জমানায় হায়দরাবাদের উপকণ্ঠে সাইবার সিটি গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু। এ বারও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজয়ওয়াড়া-গুন্টুরের মাঝে নতুন রাজধানী শহর ‘অমরাবতী’ গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁর। সে জন্য কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। জমি অধিগ্রহণে চন্দ্রবাবু যে মডেল নিয়েছেন, অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তা যেমন মোদী সরকারের উচিত বিবেচনা করে দেখা, তেমনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও বিবেচনা করে দেখতে পারেন। কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেই ইউপিএ জমানায় পাশ হওয়া জমি আইন সংস্কারের ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর প্রস্তাব ছিল, শিল্প করিডর, আবাসন, প্রতিরক্ষা কারখানা পত্তন ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে, গ্রামীণ ও সামাজিক পরিকাঠামো নির্মাণে এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্পের জন্য সরকার সরাসরি জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। সে জন্য কৃষকের কোনও সম্মতি নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। জমি অধিগ্রহণের প্রভাবে প্রান্তিক চাষি বা অন্য আর কারও জীবিকায় টান পড়ল কিনা, তা-ও সমীক্ষা করে দেখার দরকার নেই। সবক’টি বিরোধী দল এমনকী শরিক দলগুলিও এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানায়। কারণ, তাঁদের মতে এটা একটা চরম অবস্থান। এতে কৃষকদের প্রতি বঞ্চনা করা হবে। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান হল, জোর করে কৃষকের এক ছটাক জমিও নেওয়া হবে না। এটাও এক প্রকার চরম অবস্থান বলেই মত অনেকের।
কিন্তু চন্দ্রবাবু নায়ডু এই দুটোর কোনওটিই বেছে নেননি। তাঁর প্রস্তাব, কৃষকরা স্বেচ্ছায় জমি দিন। নতুন যে রাজধানী শহরের পত্তন হবে, জমির মালিক তথা কৃষককে সেই উন্নয়নের অংশীদার করা হবে। উন্নয়নের পর রাজধানী শহরের বহুমূল্য জমির একটা অংশ মূল মালিকরা বাসস্থান ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ফিরে পাবেন। তত দিন সরকার প্রতি বছর অ্যানুইটি দেবে জমির মালিককে। যা চলবে পরবর্তী দশ বছর ধরে। যে জমি দো-ফসলি, তার মালিক এক একর জমি দিলে শহর পত্তনের পর বাসস্থানের জন্য এক হাজার বর্গ গজ জমি পাবেন। সেই সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য আরও দু’শো বর্গ গজ জমি পাবেন। তা ছাড়া বছরে তিরিশ হাজার টাকা করে দশ বছর ধরে অ্যানুইটি দেওয়া হবে তাঁকে। তা প্রতি বছর দশ শতাংশ হারে বাড়বে। জমি তিন-ফসলি হলে সুবিধা আরও বেশি। এক একর জমি দান করলে রাজধানী পত্তনের পর বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য সাড়ে চারশো বর্গ গজ জমি পাবেন। সে ক্ষেত্রে অ্যানুইটি পাওয়া যাবে বছরে ৫০ হাজার টাকা করে। এ ছাড়াও সেখানকার কৃষকদের দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করেছে চন্দ্রবাবু-সরকার। সেই সঙ্গে প্রান্তিক চাষি এবং জমির ওপর নির্ভরশীল ভূমিহীনদের জন্য মাসে আড়াই হাজার টাকা ভাতা ঘোষণা করেছেন তিনি। কৃষক পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে বিকল্প পেশা বেছে নিতে পারে, সে জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গড়ার প্রক্রিয়াও চলছে।
বিজয়ওয়াড়ার তেলুগু দেশম সাংসদ শ্রীনিবার কেসিনিনির কথায়, ‘‘সরকার জোর করে জমি নিচ্ছে না। কৃষকদের স্বেচ্ছায় দেওয়া জমি নিয়ে একটি জমি ব্যাঙ্ক তৈরি করছে।’’ প্রসঙ্গত, জমি ব্যাঙ্ক তৈরি করার প্রস্তাব পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারও দিয়েছিল। কিন্তু তা এ ভাবে নয়। সরকারের মালিকানায় থাকা জমি নিয়ে ওই ব্যাঙ্ক গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল রাজ্য সরকার। শিল্প বা পরিকাঠামো নির্মাণের মতো প্রকল্পে কৃষকরা যাতে স্বেচ্ছায় জমি দেন, সে জন্য কোনও প্রস্তাব কখনও তৃণমূল সরকার দেয়নি। তেলুগু দেশমের ওই সাংসদের কথায়, ‘‘এটা ঠিকই, বহুফসলি জমি পারতপক্ষে নেওয়া ঠিক নয়। কারণ খাদ্য সুরক্ষার বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু একেবারেই তা নেওয়া যাবে না, তা-ও ভ্রান্ত মত। তা ছাড়া কৃষকরা যে ভাবে স্বেচ্ছায় জমি দিচ্ছেন, তাতে পরিষ্কার যে, অনেকেই চান তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম অন্য পেশা বা জীবিকা বেছে নিক।
তবে কিছু বাধা তো সব সময়েই আসে। নায়ডু সরকারের প্রস্তাবিত এই মডেলের বিরোধিতা করে ইতিমধ্যেই চারশো জন কৃষক আদালতে গেছেন। তাঁরা চাইছেন, বর্তমান জমি আইন অনুযায়ী তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। মজার ব্যাপার হল, এখন তাতেও রাজি অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। তবে তেলুগু দেশম নেতারা মনে করছেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নিলে বরং আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মালিকরাই। আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে লাভের সম্ভাবনা দেখে এই কৃষকরাও সরকারের প্রস্তাব মেনে নেবেন।
তেলুগু দেশম প্রধানের দেখানো পথ ধরে এগোচ্ছে অন্যরাও। পসকো-র জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার পর ওড়িশার বিজু জনতা দলও এখন কৃষকদের এ ভাবেই উন্নয়নের অংশীদার করে তোলার পক্ষে। জমি বিলে মোদী সরকার যে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছে, বিজু জনতারও তাতে আপত্তি রয়েছে। দলের লোকসভার নেতা ভর্তৃহরি মহতাবের কথায়, ‘‘কৃষকদের শিল্প বা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের অংশীদার করলে তাঁদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন যেমন হবে, তেমনই বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।’’
আবার কংগ্রেস সাংসদ তথা হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার ছেলে দীপেন্দ্র-র মতে, ‘‘চন্দ্রবাবু নায়ডু যে মডেল অনুসরণ করছেন, তা হরিয়ানায় অনেক আগেই বাস্তবায়িত হয়েছে। হরিয়ানায় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিজেপি এখন নানা অভিযোগ তুলছে ঠিকই। কিন্তু ঘটনা হল, গত দশ বছরে হরিয়ানায় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কোনও বড় কৃষক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেনি।’’
কিন্তু প্রশ্ন হল, যেখানে জমির মালিকানা খুবই ছোট ছোট অংশে বিভক্ত, সেখানে কি এই মডেল কাজ করবে? জবাবে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘জমি অধিগ্রহণে সরকারের কিছুটা ভূমিকা থাকা উচিত। তবে আসল ব্যাপার হল, কৃষকরা এখন আগের থেকে সচেতন। তাঁরা দেখে নিতে চান, জমি দিলে পরিবর্তে কী পাবেন।’’
ওই কর্তা আরও বলেন, ‘‘চন্দ্রবাবু নায়ডু যে মডেল সামনে রেখেছেন, সিঙ্গুরে বা পসকোর ক্ষেত্রে সেই একই ফর্মুলা প্রয়োগ করলে হয়তো কৃষক অসন্তোষ হতো না।’’ তবে কেন্দ্রীয় সরকার যে হেতু এখন রাজ্যগুলির ওপরেই জমি নীতি স্থির করার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাইছে, তাই অন্ধ্রের পথ ভাল না মন্দ, তা বাকি রাজ্যগুলিরও বিবেচনা করে দেখার সুযোগ রয়েছে, মনে করছেন তিনি।
কে এই পথ নেন, সেটাই দেখার?