প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ঘনিষ্ঠ’ শিল্পপতি গৌতম আদানির গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও, জীবন বিমা, ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীদের সংশয় কাটাতে মাঠে নামল মোদী সরকার।
আজ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন থেকে অর্থ মন্ত্রকের সচিবরা এ বিষয়ে প্রথম বার মুখ খুলে দাবি করেন, জীবন বিমা নিগম বা এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কে লগ্নিকারী বা আমানতকারীদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ বা তদন্তের দাবি নিয়ে মোদী সরকারের কেউ মুখ খুলতে চাননি। এ নিয়ে সংসদে আলোচনায় যেতেও মোদী সরকার রাজি হয়নি। আমেরিকার লগ্নি নিয়ে গবেষণাকারী যে সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর কারচুপি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অভিযোগ ও শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘শেয়ার বাজারে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে আলোচনা হলেও তাতে শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ কতটা, বোঝা যায় না।’’ তাঁর দাবি, এই ঘটনায় শেয়ার বাজারের লগ্নিকারীদের আস্থা নষ্ট হবে না। অর্থসচিব টি ভি সোমনাথনেরও দাবি, ‘‘এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের মোট লগ্নি বা ঋণের খুব সামান্য অংশই আদানি গোষ্ঠীতে রয়েছে। একটি সংস্থার ভাগ্যের সঙ্গে এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের ভাগ্য জড়িয়ে নেই।’’ তিনি একে ‘চায়ের কাপে তুফান’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্থিক বিষয়ক সচিব অজয় শেঠ যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শুধু দেখতে হবে, গোটা ব্যবস্থার মধ্যে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না।’’
এরই মধ্যে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ভাই জোসেফ জনসন আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ব্রিটেনের সংস্থা এলারা ক্যাপিটালের ডিরেক্টরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। বরিস জনসন গত বছর এপ্রিলে ভারত সফরে এসে প্রথম দিনই আমদাবাদে আদানি গোষ্ঠীর সদর দফতরে গিয়েছিলেন। গৌতম আদানির সঙ্গে প্রতিরক্ষা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত-ব্রিটেন যৌথ উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনতের প্রশ্ন, ‘‘বরিস জনসনের ছেলে, ২৫ বছরের থিও জনসন কি আমদাবাদের ওই সংস্থার হয়ে কাজ করছেন? ব্রিটেনে তো লোকজনকে ইস্তফা দিতে হচ্ছে। এখানে সেবি টুঁ শব্দও করছে না। প্রধানমন্ত্রী কোথায়? তিনি সংসদ থেকে পালাচ্ছেন কেন?”
শেয়ার বাজারে নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবি-র বিরুদ্ধে আগেই আদানি গোষ্ঠীর অনিয়ম দেখেও চোখ বুজে থাকার অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইট করে বলেছেন, ‘‘আইনজীবী সিরিল শ্রফের মেয়ের সঙ্গে গৌতম আদানির ছেলের বিয়ে হয়েছে। শ্রফ সেবি-র কর্পোরেট পরিচালনা, কারচুপি সংক্রান্ত কমিটিতে রয়েছেন। যদি আদৌ সেবি আদানির বিষয়ে তদন্তে নেমে থাকে, তা হলে শ্রফের সরে দাঁড়ানো উচিত।’’ আর্থিক বিষয়ক সচিবের যুক্তি, ‘‘নজরদারির অর্থ এই নয় যে প্রতিটি সংস্থার উপরে নজরদারি করতে হবে।’’ সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার দরে কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর থেকে যখন শেয়ার দর পড়ছে, তখন এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের অর্থের কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এলআইসি বিপুল অর্থ আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে লগ্নি করেছে। স্টেট ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আদানি গোষ্ঠীকে বিপুল অর্থ ঋণ দিয়েছে। এই সংস্থাগুলিতে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের গচ্ছিত সঞ্চয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিরোধীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন দেখেই সরকারকে তা নিয়ে আশ্বস্ত করতে হয়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছে, ব্যাঙ্ক ক্ষেত্র যথেষ্ট মজবুত ও স্থিতিশীল রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এ বিষয়ে ব্যাঙ্কগুলির কাছে রিপোর্ট চেয়েছিল। তার ভিত্তিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য, একটি শিল্পগোষ্ঠীকে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। কিন্তু সব মাপকাঠিতেই ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রের স্বাস্থ্য ভাল অবস্থায় রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গোটা ক্ষেত্রের উপরে ও আলাদা ভাবে ব্যাঙ্কগুলির উপরে নজর রাখছে ও ভবিষ্যতেও রাখবে। স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান দীনেশ কুমার খারা বলেছেন, আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাঙ্কের মোট বকেয়া ঋণের মাত্র ০.৮ থেকে ০.৯ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার থেকেই বিরোধীরা এ বিষয়ে সংসদে লোকসভা ও রাজ্যসভায় আলোচনা চেয়েছিলেন। দাবি ছিল, বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা মুলতুবি রেখে আগে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার দরে কারচুপি নিয়ে আলোচনা হোক। কিন্তু সরকার তাতে রাজি হয়নি। লোকসভার স্পিকার, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তাতে সায় দেননি। ফলে টানা দু’দিন সংসদ অচল থেকেছে। কংগ্রেস এতে নরেন্দ্র মোদীকে বেকায়দায় ফেলা ও বিরোধীদের এককাট্টা করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছে। কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের অভিযোগ, সংসদে আলোচনা হলে মোদী সরকারকে অস্বস্তিতে পড়তে হবে বুঝেই সরকার আলোচনা এড়াতে চাইছে।
এরই মধ্যে আইনজীবী এম এল শর্মা সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে দাবি করেছেন, হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আদানির শেয়ার দরে পতনের ফলে যে সব লগ্নিকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবিও করেছেন তিনি। শর্মার অভিযোগ, আদানির শেয়ার দরের পতনের ফলে হিন্ডেনবার্গ সংস্থা লাভবান হয়েছে।
বিরোধীদের সন্দেহ, সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি টেনে নিয়ে যাওয়ার পিছনে এ নিয়ে তদন্তের দাবি ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল থাকতে পারে। যে হেতু আমেরিকার সংস্থা আদানিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে, তাই একেও বিবিসি-র তথ্যচিত্রের মতো ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, ভারতীয় শিল্পপতিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা বলে তকমা দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। বিজেপি নেতারা এ নিয়ে মুখ না খুললেও প্রবীণ আইনজীবী ও আদানি গোষ্ঠীর প্রাক্তন কৌঁসুলি হরিশ সালভে বলেছেন, এক জন ভারতীয় ব্যবসায়ী বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন, তাতে কেউ খুশি নন। তাঁর যুক্তি, আদানি গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সংস্থাই শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত। সমস্ত নথি প্রকাশ্যে রয়েছে। সেখানে গোপন তদন্ত করার দাবিই অবাস্তব। আর এক আইনজীবী তথা বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ মহেশ জেঠমলানি যুক্তি দিয়েছেন, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার দরের পতনের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও ভূমিকা নেই।
আদানিদের পাশে দাঁড়িয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। সংগঠনের যুগ্ম-আহ্বায়ক অশ্বিনী মহাজনের দাবি, ‘‘যারা গবেষণার নামে ভারতীয় সংস্থার বদনাম করছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ করা উচিত।’’