শিলংয়ে সিবিআই দফতরে ঢুকছেন কুণাল ঘোষ (বাঁ দিকে) ও রাজীব কুমার। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
রবিবার সকাল দশটাতেই শিলংয়ের সিবিআই দফতরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ। কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমার ঢোকেন তার ২০ মিনিট পরে।
এ দিন সকালে কুণাল সিবিআই দফতরে ঢোকার পরে অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, সকাল থেকেই তাঁকে রাজীব কুমারের মুখোমুখি বসানো হবে। কিন্তু সকাল দশটার পর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত কুণাল ও তাঁর আইনজীবী অয়ন চক্রবর্তীকে নিয়ে সিবিআইয়ের একটি দল আলাদা করে বসে। তার পরে ৭.৩০ নাগাদ কুণালের সঙ্গে রাজীব কুমারকে মুখোমুখি বসানো হয়। রাত ৯.৪৫ পর্যন্ত দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সে সব শেষ হলে রাজীব প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে তাঁর লিখিত বয়ান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখে রাত ১০.৪৫ নাগাদ সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে আসেন। এই সময় কুণালকে অন্য একটি ঘরে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাত ১১.৫ নাগাদ কুণাল সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে হোটেলে যান।
সারদা কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করেছিল রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। সেই সিটের সদস্য ছিলেন রাজীব কুমার। কুণাল দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করেছেন, সে সময় তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তথ্যপ্রমাণ সিটের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সারদা কাণ্ডে কোন কোন প্রভাবশালী জড়িত, সে সম্পর্কে সিট-কে তিনি জানিয়েছিলেন। কাদের জেরা করলে পুলিশ আরও বেশি তথ্যপ্রমাণ পেতে পারে, তা-ও জানিয়েছিলেন। চিঠি দিয়ে এ সব রাজীব কুমারকেও জানান। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানো হয়নি বলে বারবার অভিযোগ করেছেন কুণাল। সারদা তদন্তে রাজীবের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল না বলেও অভিযোগ করেছেন এই প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ।
আরও পডু়ন: রোজভ্যালি কাণ্ডেও রাজীব কুমারের বয়ান রেকর্ড, শিলংয়ে সিবিআইয়ের আলাদা দল
এ দিন সিবিআই অফিসারেরা কুণালের যাবতীয় অভিযোগ এবং তার সপক্ষে তাঁর কাছে কী ধরনের নথি ও তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, সে সব খতিয়ে দেখেন। প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা ধরে এই পর্ব চলে। মাঝে এক ঘণ্টার বিশ্রাম। কুণালের অভিযোগ এবং দাবির সপক্ষে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ, চিঠির প্রতিলিপি পাওয়ার পরে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে তাঁকে বসানো হয় রাজীব কুমারের সামনে। সেই মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব চলেছে রাত ৯টা ৪৫ পর্যন্ত। সিবিআইয়ের এক কর্তা জানিয়েছেন, দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে এই জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব সোমবারেও চলতে পারে।
রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ যে আরও চলতে পারে, তা মালুম হয়েছে রবিবার সন্ধ্যায়, যখন কলকাতা থেকে প্রচুর নথিপত্র নিয়ে শিলংয়ের সিবিআই দফতরে ডেকে নেওয়া হয়েছে রোজ ভ্যালি তদন্তের তদন্তকারী মহিলা অফিসার শোজোম শেরপাকে। রাত ১০টা ১০ নাগাদ শোজোম শেরপা সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে যান।
সিবিআইয়ের অভিযোগ, দুর্গাপুরে রোজ ভ্যালি নিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের হলেও নথিপত্র সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে সেই মামলার কথা উল্লেখ করেনি সিট। যার ফলে, তাদের রোজ ভ্যালি নিয়ে মূল মামলা ভুবনেশ্বরে করতে হয়েছে। যদিও সিট-এর দাবি, সিবিআইকে দুর্গাপুরের অভিযোগ নিয়ে জানানো হয়েছে।
রবিবারের সকালটা শুরু হয়েছিল নাটকীয় ভাবেই। ওকল্যান্ডের এই সিবিআই দফতরের পাশে স্থানীয় পাড়ার ছেলেরা সরস্বতী পুজো করছিলেন। আইনজীবী অয়নকে নিয়ে কুণাল ১০টায় সিবিআই দফতরের সামনে নেমে সেই পুজো দেখতে পেয়ে সটান সেখানে চলে যান। প্রণাম সেরে ঢুকে যান সিবিআই দফতরে। কুণালের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দফতরে ঢোকেন সিবিআইয়ের এসপি পি সি কল্যাণ। তার আগে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে সিবিআইয়ের ডিএসপি তথাগত বর্ধনের নেতৃত্বে একটি দল শিলং দফতরে ঢোকে। প্রায় একই সময়ে দফতরের বাইরে এসে উপস্থিত হয় কলকাতা পুলিশের এসটিএফ-এর ৬ অফিসারের দল। ১০টা ২০ মিনিটে সঙ্গী দুই পুলিশকর্তা জাভেদ শামিম এবং মুরলীধর শর্মাকে নিয়ে পৌঁছন রাজীব কুমার। রাজীবকে সাড়ে দশটা নাগাদ আলাদা ঘরে নিয়ে যাওয়ার পরে জাভেদ ও মুরলীধর বেরিয়ে যান।
শনিবার রাজীব কুমারকে অনুরোধ করা হলেও তিনি লাঞ্চ করেননি। কিন্তু, রবিবার দুপুরে ঘণ্টাখানেকের জন্য বাইরে বেরিয়ে লাঞ্চ সেরে আসেন। কুণালকে অবশ্য বেরোতে দেখা যায়নি। সূত্রের খবর, মাঝের এক ঘণ্টা বিরতিতে তিনি এক প্লেট মোমো খেয়েছেন। রাজীব কুমারের সঙ্গে কলকাতা থেকে আসা আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব এ দিন বলেন, ‘‘রাজীব কুমারের আইনজীবী হিসেবে আমাকে সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়নি। রাজীব কুমার এই মামলার সাক্ষী। কুণাল অভিযুক্ত। তাঁর আইনজীবীকে আজ কুণালের সঙ্গে সব সময় থাকতে দেওয়া হয়েছে। এটা পক্ষপাতিত্ব ছাড়া কিছু নয়।’’
রাজীবের ঘনিষ্ঠ মহল দাবি করেছে, তিনি তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। এমনকি, সিবিআইয়ের প্রশ্নের মুখে জানিয়েছেন, তিনি চান, গরিবরা তাঁদের টাকা ফেরত পান। ওই সূত্রের দাবি, রাজীব জানিয়েছেন, সিটের উদ্দেশ্যই ছিল গরিবদের টাকা ফেরত দেওয়া। এর প্রেক্ষিতেই বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশনের প্রসঙ্গ তুলে জানিয়েছেন, ৩ লক্ষ গরিব মানুষকে সেই সময়ে টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি মানুষের দাবি ও কাগজপত্র খতিয়ে দেখে তাঁদের প্রাপ্য টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সিট-এর অফিসারদের প্রাণপাত করে খাটতে হয়েছে।
রাজীব কুমার তদন্তে অসহযোগিতা করছেন, সিবিআইয়ের তরফে রবিবার রাত পর্যন্ত এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সূত্রের দাবি, সিবিআই ম্যানুয়ালে কী
রয়েছে, সেটা যখন তিনি তাঁর চেয়ে জুনিয়র অফিসারদের সামনে গড়গড়িয়ে বলে দিয়েছেন, তখন খানিকটা থতমতই খেয়েছেন সিবিআই অফিসারেরা।