তলব তো হল, নথি কই চিন্তায় সিবিআই

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আদালতে হাজির হলে সিবিআইয়ের ভূমিকা কী হবে, তাই নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। সিবিআই কর্তারা কিন্তু এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, বিচারাধীন বিষয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। কিন্তু সিবিআই অন্দরমহলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ফের আদালতে প্যাঁচে পড়তে হতে পারে তদন্তকারীদের। কারণ সিবিআই এখনও মনে করে, কয়লা বণ্টন মামলায় মনমোহন সিংহ, কুমারমঙ্গলম বিড়লা, পি সি পরাখদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই!

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৫
Share:

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আদালতে হাজির হলে সিবিআইয়ের ভূমিকা কী হবে, তাই নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। সিবিআই কর্তারা কিন্তু এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, বিচারাধীন বিষয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। কিন্তু সিবিআই অন্দরমহলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ফের আদালতে প্যাঁচে পড়তে হতে পারে তদন্তকারীদের। কারণ সিবিআই এখনও মনে করে, কয়লা বণ্টন মামলায় মনমোহন সিংহ, কুমারমঙ্গলম বিড়লা, পি সি পরাখদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই!

Advertisement

কয়লা ব্লক বণ্টন মামলায় এর আগে দু-দু’বার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছে সিবিআই! বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক ভরত পরাশর তো বটেই, সরকারি আইনজীবীও ওড়িশার তালাবিড়া কয়লাখনি বণ্টনে দুর্নীতির তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সিবিআই প্রথমে বলেছিল, মনমোহন-বিড়লা-পরাখদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তদন্তকারী অফিসার মনমোহনকে জেরা করতে চাইলে তা খারিজ করে দিয়েছিলেন সিবিআইয়ের প্রাক্তন প্রধান রঞ্জিৎ সিন্হা নিজেই। অথচ পরে সেই সিবিআই-ই নতুন তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সরকারি আইনজীবী দাবি করেছেন, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। সেই মোতাবেক আদালত মনমোহন-কুমারমঙ্গলম-পরাখ, তিন জনকেই অভিযুক্ত বলে সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু আদালতে হাজির হলে তাঁদের বিরুদ্ধে যদি যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ হাজির করা না যায়, তা হলে কী হবে, ভেবে পাচ্ছেন না সিবিআই কর্তারা।

এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? কারণ, তালাবিড়ায় হিন্দালকো-কে কয়লাখনি দেওয়া নিয়ে তদন্ত প্রথম থেকেই রহস্যে মোড়া। সিবিআইয়ের অন্দরমহলে এই তদন্ত ঘিরে টানাপড়েন এবং জটিলতাও কম হয়নি। গত বছর অগস্টে তালাবিড়া নিয়ে তদন্ত বন্ধ করতে চেয়ে আদালতে ক্লোজার রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। আদালতে তারা জানিয়েছিল, কুমারমঙ্গলম বিড়লা বা কোনও সরকারি আমলা বেআইনি কাজ করেছেন, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। আদালত অবশ্য সিবিআইয়ের সেই রিপোর্টে খুশি হতে পারেনি। বিচারক ভরত পরাশর প্রশ্ন তুলেছিলেন, এত তাড়াহুড়ো কীসের? সিবিআইয়ের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়, ২০১৩-র অক্টোবরে তারা যাদের নামে এফআইআর দায়ের করেছিল, সেই বিড়লা বা পরাখের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ প্রমাণের মতো কোনও তথ্য বা নথি তাদের হাতে নেই। আদালত এই জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করতে বলে। এই পর্বেই মনমোহনের বয়ান নথিবদ্ধ করে সিবিআই। ফেব্রুয়ারি মাসে তারা চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করার পরে সরকারি আইনজীবী রাজিন্দর সিংহ চিমা আদালতে জানান, প্রাথমিক ভাবে বেসরকারি ব্যক্তি, সংস্থা ও কিছু সরকারি আমলার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। আদালত তখন প্রশ্ন করে, ওঁদের অভিযুক্ত হিসেবে তলব করা হলে সিবিআই তথ্যপ্রমাণ পেশ করতে পারবে তো? আইনজীবী জানান, তদন্তকারীরা প্রস্তুত।

Advertisement

কিন্তু সিবিআই সূত্র বলছে অন্য কথা। সিবিআইয়ের অন্দরে কান পাতলে কর্তারা অভিযোগ করছেন, চিমা আদালতে যা বলছেন, সেটা তাঁর নিজস্ব মতামত। মনমোহন, বিড়লা বা পরাখের যোগসাজশ প্রমাণ করার মতো উপযুক্ত তথ্য বা নথি মেলেনি।

এ ব্যাপারে প্রথমে যা বলা হয়েছিল, সেটাই আসলে তাদের চূড়ান্ত মত বলে দাবি করছে সিবিআই। সরকারি আইনজীবী তা হলে অন্য কথা বললেন কেন? সিবিআই সূত্র মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কয়লা ব্লক বণ্টন মামলার তদন্ত চলছে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে। আইনজীবী চিমা

সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত বিশেষ সরকারি আইনজীবী। তিনি নিজের মতো করে সওয়াল করছেন এবং তিনি সিবিআইয়ের কাজকর্ম নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, কয়লা বণ্টন মামলার তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে গোড়া থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে সিবিআইয়ের উপর ইউপিএ সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে কি না, তা নিয়ে এক সময় যথেষ্ট সরব ছিলেন বিরোধীরা। ফলে তদন্ত কতটা স্বচ্ছ ভাবে হয়েছে বা কতটা তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা গিয়েছে, এই সব প্রশ্নে সিবিআই বেশ চাপে রয়েছে।

সিবিআই সূত্রের খবর, প্রথমে যে স্ক্রিনিং কমিটির বৈঠকে তালাবিড়া কয়লাখনি বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেই বৈঠকের বিবরণী পাওয়া যায়নি। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, হিন্দালকো-কে তালাবিড়া খনির কয়লা দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হস্তক্ষেপের পরে সেই সিদ্ধান্ত বদলে যায় বলে সূত্রের দাবি। কিন্তু প্রথম বৈঠকের বিবরণী যদি সত্যিই হারিয়ে গিয়ে থাকে, সরকারি ভাবে তারও রেকর্ড থাকার কথা। মন্ত্রকের কোনও অফিসার কিন্তু সরকারি ভাবে বলেননি যে, বিবরণী হারিয়ে গিয়েছে। ফলে তেমন কোনও নথি পেশ করতে পারেনি সিবিআই। আদালতে কেস ডায়েরি পেশ করতেও তারা গড়িমসি করেছিল। এমনকী তদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে এমন অনেক সাদা পাতা, আবছা নথি তারা জমা দিয়েছিল, যা বিচারক পড়তেই পারেননি। আইনজীবী চিমা-ও এই নিয়ে আদালতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। চিমার যুক্তি ছিল, সিবিআই আদালতে এমন সব নথি পাঠাচ্ছে, যা নিয়ে আদালতে আইনজীবীদেরই ভর্ৎসনা শুনতে হচ্ছে।

ক্লোজার রিপোর্ট খতিয়ে দেখার পরে মনমোহন সিংহকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু ঘটনা হল, মনমোহনকে জেরা করতে চেয়েছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার। কিন্তু তৎকালীন সিবিআই-প্রধান রঞ্জিৎ সিন্হাই তার অনুমতি দেননি। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিবিআইয়ের প্রশ্ন তোলার এক্তিয়ার নেই। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি টি কে এ নায়ারের মতো শীর্ষকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কাজেই মনমোহনকে জেরা করার প্রয়োজন নেই।

আদালতের ধমক খেয়ে পরে অবশ্য মনমোহনকে জেরা করা হয়। এখন অভিযুক্ত হিসেবে তাঁকে আদালতে তলব করাও হচ্ছে। কিন্তু কতটা কী তথ্যপ্রমাণ পেশ করা যাবে, তা ভেবেই ঘুম ছুটছে সিবিআইয়ের। মনমোহনদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে আদালতে জানিয়ে দিয়েছেন আইনজীবী। তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলেও দাবি করেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দুর্নীতির আদৌ কোনও পাথুরে প্রমাণ পেশ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে সিবিআই নিজেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement