Budget

ব্রিফকেস হাতে তিনি এগোচ্ছেন, আহা...

তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। আমরা যেন সিনেমা দেখছি।

Advertisement

কুমার রানা

লেখক প্রতীচী ট্রাস্টে কর্মরত শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ১৮:১৯
Share:

ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, হাতে ব্রিফকেস। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। আমরা যেন সিনেমা দেখছি। হাতের ব্রিফকেসে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা, মুদ্রায় নয়, ছাপানো বক্তৃতায়। সিনেমাতে ব্রিফকেস হাতবদল হয়, এখানে নায়ক গটগটিয়ে ঢুকে পড়বেন সংসদে। দীর্ঘ ক্ষণ ধরে তিনি পড়ে যাবেন বস্তা বস্তা টাকার অঙ্ক।

Advertisement

এর নাম বাজেট বক্তৃতা। বহু শ্রমে, মাথা ঘামিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রকের আধিকারিকেরা নানা জটিল হিসেব কষে আগামী বছরে দেশের মানুষের কাছ থেকে কত টাকা তোলা হবে, আর তাঁদের জন্য কত খরচ করা হবে তার লিস্টি তৈরি করেছেন। তিনি, দেশের অর্থমন্ত্রী, আজকের দিনের নায়ক, সেটা দেশবাসীকে জানাবেন।

এ যেন এক বার্ষিক উৎসব। সংসদে সরকারি পক্ষ হাততালি দেবে, বিরোধী পক্ষ দুয়ো দেবে। বিশেষজ্ঞজন কয়েক দিন ধরে সংবাদ মাধ্যমে জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য করবেন, প্রবন্ধ লিখবেন। আপিস-কাছারিতে লোকে তর্ক করবে। তার পর, যেমন সিনেমা হল থেকে বেরনোর কিছু ক্ষণের মধ্যেই দর্শক দিন-দুনিয়ায় ফিরে আসে, তেমনই উৎসবে সামিল লোকেরা অন্য কোনও পরনিন্দা পরচর্চায় ব্যাপৃত হয়। বাজেট তাদের সবাইকে কিছু না কিছু দেয়– করছাড়, বিলাসের বন্দোবস্তে সংযোজন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

Advertisement

এ তো গেল একটা দেশের লোকেদের কথা। এ দেশের ভিতরে যে আরও অনেক দেশ আছে, যেখানে এক একটা লোকই একটা দেশ, তাদের কী হল? যে দেশগুলোর নাম রামভজন রাম, চুড়কি মান্ডি, কাদের মিঞা— তাদের জন্য ব্রিফকেস থেকে কী বেরোলো? না না, তাদের জন্যও অনেক কিছু আছে। এই তো বাজারে খবর, তাদের জন্য নাকি সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে। এটা নমুনা মাত্র। গরিব, বাজেট বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ না জানা জনতার জন্য আরও অনেক প্রকল্প আছে। যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষা। এই তো গেল বারের বক্তৃতায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “২০১৭ সালের মধ্যে কালাজ্বর ও ফাইলেরিয়া নির্মূল করে দেওয়া হবে”। তার আগের বছর জানিয়েছিলেন, গরিবদের জন্য “স্বাস্থ্যবিমা ৩০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লক্ষ টাকা করা হবে।” স্বাস্থ্যের সমস্যাটা যে প্রধানত গরিবদের মধ্যেই সবচেয়ে তীব্র, তা ‘হৃদয়ঙ্গম’ করে বিষয়টাকে রেখেইছিলেন ‘দারিদ্র দূরীকরণ’ অনুভাগে- স্বাস্থ্যের জন্য বাজেট বক্তৃতায় আলাদা কোনও শিরোনামও রাখেননি।

এটা অন্য কথা, তাঁকে গরিবদের (এক)পাশে রেখে বড়লোকদেরও দেখতে হয়। তাই, গেল বারের বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যত টাকা খরচ ধরা হল, তার বেশির ভাগটা বেরিয়ে গেল নতুন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (এইমস) বানানো, বিদেশে পাড়ি দিতে পারে এমন ৫০০০ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার তৈরি করা, ইত্যাদি খাতে। অতএব কালাজ্বর নির্মূল করার ব্যাপারটা স্থগিত রাখতে হল। এত বড় দেশে রোগভোগের খবর আসতে দেরি হয়, কিন্তু কাঁচা খবর যেটুকু ভারত সরকারেরই স্বাস্থ্য দফতর থেকে পাওয়া গেছে, যার ভিত্তি ২০১৭-র গোড়ার দিকের হিসেব, তাতেই দেখা যাচ্ছে কয়েক হাজার লোক কালাজ্বরে আক্রান্ত! তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ২০১৮-তে কুষ্ঠরোগ নির্মূল হবে, ২০২০-তে হাম এবং ২০২৫-এ যক্ষ্মার নাম-নিশান মিটিয়ে দেবেন। কী হতে পারে তা বাজেট নিয়ে ওয়াকিফ সকলের জানা, শুধু জানা নেই সেই গরিব, অসহায় লোকগুলোর, কেন না তাদের কল্পনায় বাজেটেরই অস্তিত্ব নেই। ঘোষণা কী, তা তারা বোঝে না, তারা যেটুকু চাইতে পারে তা-ও মনে মনে, কেন না জোরে কথা বলার হক নেই। হাতের কাছে ঈষৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা— না, তার কণামাত্রও তাদের জন্য নেই। উল্টে যেটা আছে তা হল— গ্রামের পর গ্রাম, মহল্লার পর মহল্লা জুড়ে অনাহার, অপুষ্টি, দূষিত জল-বাতাস— অস্বাস্থ্যের সমূহ কারণের সঙ্গে সহবাস। অসুখ হলে হাতুড়ে বা মন্ত্রবিদ্যার চিকিৎসা, এবং প্রায়শই অকালমৃত্যু। ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, যক্ষ্মা, সিলিকোসিস— তালিকা অসীম— তাঁদের ললাটলিখন।

চাওয়ার ক্ষমতা থাকলে তারা বলতে পারত, রোগ নির্মূল করার কী হল? আর রোগের এক অন্যতম কারণ দারিদ্র দূরীকরণের কী হল? ২০১৬-র বাজেটে আপনি যে বলেছিলেন ন্যূনতম মজুরি দিনে সাড়ে তিনশো টাকা করা হবে, কোথায় গেল সে টাকা? সরকার নিজেই তার প্রকল্পে বাজেটে ঘোষিত মজুরি দেয় না। একশো দিনের কাজে নিযুক্ত এগারো কোটিরও বেশি মজুরের জন্য ঘোষিত মজুরির তালিকাটার দিকে তাকান- প্রতি রাজ্যেই মজুরি দর দৈনিক সাড়ে তিনশো টাকার প্রায় অর্ধেক। দক্ষিণের কেরল, তামিলনাডু, কর্নাটক, এবং পঞ্জাবের মতো কিছু রাজ্যে একটু ভাল– যদিও বাজেটে ঘোষিত মজুরির চেয়ে অনেকটাই কম। (লক্ষণীয়, এ সংক্রান্ত বাজেট ঘোষণা ২০১৬ সালের, আর একশো দিনের কাজের মজুরি সংক্রান্ত নোটিসের তারিখ ২০১৭-র ২৮ ফেব্রুয়ারি!)

আবার, গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যেটুকু টিকে আছে তার কৃতিত্বের বেশির ভাগটাই দশ লক্ষাধিক আশা কর্মীদের। তাঁরা যে পারিশ্রমিক পান তা দিনের হিসেবে ১০০ টাকার মতো, দেশে প্রায় ২৫ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা আছেন, তাঁরা যা পান, তা ন্যূনতম মজুরির সামান্য খণ্ডমাত্র। এক কোটিরও বেশি মিড-ডে মিল রাঁধুনির আয়টাকে ঘণ্টায় হিসেবে করলে দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ টাকা, আর মাননীয় সংসদ সদস্যদের কিছু না করেই প্রতি ঘণ্টায় আয় হয় এক হাজার টাকার বেশি। বড় আমলাদেরও প্রায় তাই।

এই একটা ব্যাপারে গরিবদের সঙ্গে সাংসদ, মন্ত্রী, আমলা এবং বৃহৎ বাণিজ্যিকগোষ্ঠীর খুব মিল। বাজেটে কী থাকল না থাকল তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বছর বাজেট আসে মহাপ্রবঞ্চক আর চিরবঞ্চিতের এই স্থায়ী সম্পর্ক আরও মজবুত করে রাখার জন্য। তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিকে কিছু উপঢৌকন, কিছু উৎকোচ দিয়ে দেশ থেকে, দেশের মানুষের থেকে আলাদা রেখে দেওয়ার জন্য।

এ পর্যন্ত সিনেমার সঙ্গে অনেক মিল। শুধু একটাই গরমিল। সিনেমায় আগে থেকে জানা যায় ব্রিফকেস হাতে যিনি নামলেন তিনি নায়ক না খলনায়ক। এখানে তা হবার নয়, কেননা, তিনি নায়ক বা খলনায়ক নন, তিনি এ রঙ্গের এক প্রযোজক। এক বার এমনই এক অর্থমন্ত্রীর ব্রিফকেস হাতে নামা ছবি দেখে বাচ্চা স্কুলছাত্র খবরের কাগজ পড়তে থাকা মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই লোকটা কে? খুব বড়লোক, না প্লেয়ার? না হলে তার ছবি ছাপবে কেন? মাস্টার উত্তর দিয়েছিলেন, বড়লোকদের দলের ক্যাপ্টেন, নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেনও বলতে পারিস!

ক্যাপ্টেন গাড়ি থেকে নামছেন। হাতে ব্রিফকেস। ব্রিফকেস ভর্তি অনৃতভাষণ। তাঁর দলের জেতার গ্যারান্টি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement