লোকসভা ভোটের আগে শেষ বাজেটে কামধেনু নরেন্দ্র মোদী

চাষি, মধ্যবিত্ত, নোট বাতিলের ধাক্কায় কাজ হারানো শ্রমিক-মজুর, যে যা চাইবে সব দেব— এমন ভাব দেখিয়েই লোকসভা ভোটের আগে শেষ বাজেট পেশ করল মোদী সরকার। বাজেট না বলে যাকে ‘ভোটের ইস্তাহার’ বলছেন সমালোচকেরা।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী 

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৯
Share:

কামধেনু হয়ে উঠল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

ভোটের, থুড়ি ভোটারদের ভয়ে কামধেনু হয়ে উঠল নরেন্দ্র মোদীর সরকার!

Advertisement

চাষি, মধ্যবিত্ত, নোট বাতিলের ধাক্কায় কাজ হারানো শ্রমিক-মজুর, যে যা চাইবে সব দেব— এমন ভাব দেখিয়েই লোকসভা ভোটের আগে শেষ বাজেট পেশ করল মোদী সরকার। বাজেট না বলে যাকে ‘ভোটের ইস্তাহার’ বলছেন সমালোচকেরা।

যে সরকারের মেয়াদ আর ১০০ দিনও বাকি নেই, সেই মোদী সরকারের ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বাজেট পেশ করতে গিয়ে শিকেয় তুলে দিলেন রীতিনীতি, রেওয়াজ সব কিছু। অন্তর্বর্তী বাজেটের নামে কার্যত পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন। এত দিন ২০২২-এ ‘নতুন ভারত’-এর কথা বলে মোদী এমন ভাব করতেন যে, তাঁর দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরা নিশ্চিত। আজ একধাপ এগিয়ে বাজেটে ২০৩০ পর্যন্ত স্বপ্ন ফেরি করলেন প্রধানমন্ত্রী!

Advertisement

আরও পড়ুন: পর্বতের মূষিক প্রসব! বোঝার ভুলেই উল্লাস আয়করে

তিন শ্রেণির ভোটারদের মন জিততে পীযূষ এ দিন তিনটি তাস খেলেছেন। এক, মধ্যবিত্তের মন জিততে প্রথা ভেঙে অন্তর্বর্তী বাজেটে আয়করে রদবদল করেছেন। অতীতে যার উদাহরণ বিরল। সঞ্চয়ে নানা ছাড়ের পর করযোগ্য আয় ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে তাতে কোনও আয়কর মেটাতে হবে না। দুই, ছোট চাষিদের জন্য সরকারের কোষাগার থেকে বছরে ৬ হাজার টাকা ‘সাহায্য’ পাইয়ে দেওয়া হবে। তিন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-মজুরের জন্য ঘোষণা হয়েছে পেনশন প্রকল্প।

তিন রাজ্যে কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হারানোর পরে চাষি-মধ্যবিত্ত-শ্রমিক শ্রেণির ক্ষোভই বিজেপির মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। সেই ক্ষতে মলম লাগানোর পাশাপাশিই হিন্দুত্বের আবেগে সুড়সুড়ি দিতেও ছাড়লেন না পীযূষ। গরুদের উন্নয়নে ‘রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ’ ঘোষণা করে ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু ইচ্ছেপূরণের কামধেনু হতে গিয়ে রাজকোষ ঘাটতি পূরণের লক্ষ্য ফের জলাঞ্জলি দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ভোট টানতে মোদী সরকারের দান-খয়রাতির অর্থ জোগাবে কোন গৌরী সেন?

মোদীর দাবি, ‘‘এই বাজেট নতুন ভারত-এর জন্য।’’ কংগ্রেস বলছে, আসলে নতুন ভোটারদের জন্য। বিজেপির এত দিন হিসেব ছিল, ২২ কোটি পরিবারকে কিছু না কিছু সুবিধা মোদী সরকার পাইয়ে দিয়েছে। আজ মোদীর দাবি, এই বাজেটে ৩ কোটি মধ্যবিত্ত করদাতা, ১২ কোটি চাষি, ৩০ কোটির বেশি শ্রমিক-মজুর উপকৃত হবেন। কংগ্রেস একে ‘ভোটের জন্য ঘুষ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের কথায়, ‘‘এটা ভোট অন অ্যাকাউন্ট নয়। ভোটের জন্য অ্যাকাউন্ট! দীর্ঘতম অন্তর্বর্তী বাজেট বক্তৃতা, তার সঙ্গে ভোট প্রচারের বক্তৃতা।’’

বস্তুত, সংসদের এই বাজেট থেকে ভোটের প্রচার শুরুও করে দিয়েছে বিজেপি। তার জন্য নাটকের সমস্ত উপাদান এ দিন মজুতই ছিল। চাষির জন্য আয় ঘোষণা করে পীযূষ হাসি মুখে থেমে গিয়েছেন, আর দল বেঁধে টেবিল চাপড়েছেন বিজেপির মন্ত্রী-সাংসদেরা। আয়করে ছাড়ের পর নাটক তুঙ্গে উঠেছে। ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয়ে কর মকুব করে পীযূষ এমন ভাব দেখালেন যেন আয়কর ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করে দিলেন! মোদী টেবিল চাপড়ে দিলেন। দেখাদেখি বিজেপির বাকি সাংসদরাও শুরু করলেন নাগাড়ে টেবিল চাপড়ানো। বাজেট বক্তৃতা থামিয়ে কয়েক মিনিট ধরে টেবিল চাপড়ে ‘মোদী’ ‘মোদী’ স্লোগান উঠল।

তবে রাজকোষ ঘাটতি যাতে লাগামছাড়া না হয়ে যায়, সে জন্য বেশ কিছু হিসেবের কেরামতি করতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। কেন্দ্রীয় করে রাজ্যের ভাগ গত বারের তুলনায় ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ছাঁটাই করেছেন।

এর ফলে রাজ্যগুলির ঘাটতি বাড়বে। জিডিপি-র তুলনায় যাতে ঘাটতি কম দেখায়, তার জন্য সংশোধিত হিসেব মেনে জিডিপি বড় করে ধরেছেন। চলতি বছরে একশো দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, তফসিলি জাতির উন্নয়নের প্রকল্প, স্বচ্ছ ভারত, পথ সুরক্ষার মতো প্রকল্পে বরাদ্দের তুলনায় খরচ ছাঁটাই করেছেন। সারে ভর্তুকির অনেক খরচ পরের বছরের খাতায় ঠেলে দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, পীযূষ আগামী বছরের জন্য আয়ের হিসেব যা দেখিয়েছেন, তা-ও অবিশ্বাস্য। আয়কর কমিয়েও ১৮,৫০০ কোটি টাকার লোকসান মেনে নিয়েছেন। অথচ আয়কর ও কর্পোরেট কর থেকে ১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা আয় বাড়বে বলে অঙ্ক কষেছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আরও ডিভিডেন্ড দেবে বলেও ধরে নিয়েছেন।
প্রশ্ন হল, মোদী-গয়ালের কামধেনু বাজেট কি চাষি-মধ্যবিত্ত-শ্রমিকের ভোট টানতে পারবে? বিরোধীদের বক্তব্য, ঘোষণার ঢক্কানিনাদের তুলনায় আসল প্রাপ্তি সামান্যই। ফলে বিজেপির আশা পূরণ হবে না। বিরোধীরা হিসেব করে দেখিয়ে দিচ্ছেন, চাষিদের জন্য বছরে ৬ হাজার টাকা মানে মাসে পাঁচশো টাকা। অর্থাৎ দিনে ১৭ টাকা! আয়করের বোঝা কমানোর সুবিধাও সকলে পাবেন না। পাশাপাশি, বিপুল সংখ্যক বেকারের জন্য নতুন কাজের কোনও সন্ধান নেই বাজেটে। যদিও অর্থমন্ত্রীর অনুমান, অর্থনীতির জন্য এত ভাল কিছু হলে চাকরিও নিশ্চয়ই তৈরি হবে।
চিদম্বরমের মন্তব্য, ‘‘এটা স্পষ্ট যে, এই সরকার নিজেই আর ক্ষমতায় ফেরার আশা করছে না। তাই মরিয়া হয়ে সব প্রথা ভেঙে অন্তর্বর্তী বাজেটেই সব ঘোষণা করে দিচ্ছে! ক্ষমতায় ফেরার বিষয়ে নিশ্চিত থাকলে এ ভাবে প্রথা ভাঙত না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement