কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুকথার প্রতিবাদে কংগ্রেসের সঙ্গে ধর্নায় তাপস পাল, শতাব্দী রায়-সহ তৃণমূল সাংসদরা। শুক্রবার সংসদ ভবন চত্বরে। ছবি: প্রেম সিংহ।
সংসদে দিনভর কাজের চাপ শেষে বৃহস্পতিবার রাতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। দলের এক সাংসদের কাছ থেকে আপৎকালীন বার্তা পেলেন সেখানেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে খুঁজছেন। ইয়েচুরি প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কোথায় ফোন করবেন! শেষমেশ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের মোবাইলে ফোন করে দলের পলিটব্যুরো সতীর্থকে পেলেন এবং বেদম ঝাঁঝের মুখে পড়লেন!
ততক্ষণে রাজধানীতে ভি পি হাউসের ফ্ল্যাটে বসে একই অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে সাংসদ মহম্মদ সেলিমের। তিনিও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ফোন এবং প্রবল তিরস্কারের মুখে পড়েছেন! কোথায় ভুল হয়েছে, বুঝতে পেরে সেলিম তখন যোগাযোগ শুরু করেছেন পলিটব্যুরোর অন্য নেতাদের সঙ্গে। আর ইয়েচুরিকে প্রথমে না পেয়ে বুদ্ধবাবুর ফোন চলে গিয়েছে দলের আরও দুই নেতার কাছে। সঙ্গে নির্দেশ, এখনই বিবৃতি জারি করে জানাতে হবে তৃণমূলের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচিতে সিপিএম নেই। ঘড়ির কাঁটা তখন মধ্যরাত ছুঁচ্ছে!
যাঁর জন্য এত কাণ্ড, তাঁর নম্বরে অবিরাম ডায়াল করে যাচ্ছেন সেলিম। কিন্তু পি করুণাকরনের মোবাইল বন্ধ! অবশেষে সেলিম দ্বারস্থ হলেন ইয়েচুরি এবং বুদ্ধবাবুর। ঠিক হল, বুদ্ধবাবুই শেষ পর্যন্ত বিবৃতি জারি করবেন। তা-ই হল। নাকচ হয়ে গেল করুণাকরনের সিদ্ধান্ত। স্বস্তির শ্বাস পড়ল আলিমুদ্দিনে! কেন না, বিমান বসুরা নবান্নে গিয়ে ফিশ ফ্রাই-কফিতে আপ্যায়িত হয়ে আসার পরে দলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, এ বার কি তবে সিপিএম এ রাজ্যে তৃণমূলের বি-টিমে পরিণত হচ্ছে? বুদ্ধবাবুর বিবৃতি স্পষ্ট করে দিল বিজেপি নয়, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের প্রধান শত্রু তৃণমূলই।
বৃহস্পতিবার বেশি রাতে এ ভাবেই বিধ্বংসী তৎপরতায় প্রায় গোললাইন সেভ করেছেন বুদ্ধবাবু! কী গোল? দলের একাংশ বলছে, আত্মঘাতী গোল! যা খাইয়ে দিচ্ছিলেন করুণাকরন এবং সেলিম তা ঠেকাতে যাননি দেখে যুগপৎ বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ বুদ্ধবাবু। কলকাতা থেকে মধ্যরাতের তৎপরতায় অবশ্য বল জালে ঢোকার আগেই আটকানো গিয়েছে!
কী হয়েছিল সংসদে? যার জন্য এমন হুলুস্থূল সিপিএমের অন্দরে? বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির অশালীন মন্তব্য এবং তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে লোকসভায় মাইক বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে শুক্রবার সংসদ চত্বরে গাঁধীমূর্তির পাদদেশে সব বিরোধী দল মুখে কালো কাপড় বেঁধে ধর্না দেবে বলে ঠিক হয়েছিল। তৃণমূল সূত্রের খবর, তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন সিপিএমের লোকসভার দলনেতা করুণাকরনও। সব বিরোধী রাজি দেখে তিনিও রাজি হয়েছিলেন। তখন ভাবেননি, যে দলের কোষাগারে তাপস পালের মতো ‘রত্ন’ আছে, তাদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে অন্য কারও কুকথার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া বঙ্গ রাজনীতিতে কী হতে পারে!
ভেবেছিলেন বুদ্ধবাবু। তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে বিভ্রাট ঠেকিয়েছেন এবং রাতেই বিবৃতি দিয়েছেন, “মন্ত্রী যা বলেছেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আমাদের পার্টি সংসদে এ ব্যাপারে সরব। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে কোনও যৌথ কর্মসূচিতে আমরা যেতে পারি না। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াইয়ে তৃণমূলের বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা নেই! তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের শাস্তির দাবিতে আমরা অনড়।” কিন্তু বুদ্ধবাবু ভেবে পাননি, দিল্লিতে দলের কেউ এটা ভাবলেন না কেন!
নৈশ ‘অপারেশনে’র পরে এ দিন সকাল থেকে অবশ্য দিল্লির ছবি অন্য। সাতসকালেই সিপিএমের সংসদীয় দফতর থেকে ফোন যায়, কেউ যেন ভুল করেও ধর্নায় যোগ না দেন! সাবধানের মার নেই ভেবে দফতরের এক জন কর্মচারীকে ধর্নাস্থলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যাতে কেউ ভুল করে চলে গেলেও তাঁকে ফিরিয়ে আনা যায়! রাতেই অবশ্য বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আলোচনা সেরে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন ইয়েচুরি। ফলে, শেষ পর্যন্ত ধর্নায় না যাওয়া দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তেরই চেহারা পেয়েছে।
রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “তাপস পালের অপরাধ সাধ্বী নিরঞ্জনের থেকে এক ইঞ্চি কম নয়! তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আমরা স্লোগান দেব, তা হতে পারে না!” দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের ব্যাখ্যা, “যেটা হয়েছে, সেটা কমিউনিকেশন গ্যাপের ফল। ইচ্ছাকৃত ভাবে কারও ত্রুটি ছিল না।” পাশাপাশি তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার পাল্টা কটাক্ষ, “বুদ্ধবাবু কি এখন সংসদটাও দেখছেন? এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ওঁরা তো প্রমাণ করলেন, বিজেপি বিরোধিতায় পশ্চিমবঙ্গে আসল শক্তি তৃণমূলই!”
সিপিএমের অন্দরেও আপাতত প্রশ্ন এটাই বুদ্ধবাবুকে হস্তক্ষেপ করতে হল কেন? একই বিস্ময় বুদ্ধবাবুর নিজেরও! দলের অন্দরে তাঁর যুক্তি, লোকসভার দলনেতা করুণাকরন বাংলা রাজনীতির সাত সতেরো জানতে না-ই পারেন। কিন্তু সেলিম কী করছিলেন? তাঁরই তো সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল এমন পদক্ষেপ ঠেকাতে। উল্টে সেলিম বরং এবিপি আনন্দে দলের ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। তাঁরা যে সংসদে তাপসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে যাচ্ছেন না, তা-ও বলেছিলেন। তাতেই আরও ক্ষিপ্ত হন বুদ্ধবাবু। দলের মধ্যে তাঁর প্রশ্ন, এ রাজ্য থেকে লোকসভায় এখন সিপিএমের মাত্র দু’জন সাংসদ। মুর্শিদাবাদের বদরুদ্দোজা খান একেবারেই নবীন। তাঁর কাছ থেকে বিশেষ কিছু আশা করার নেই। কিন্তু সতীর্থদের কাছে বারেবারেই বুদ্ধবাবুর জিজ্ঞাস্য, “সেলিম কী করছিল?”
দলের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, সেলিম কি বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছিলেন? যদিও সেলিমের ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের যে কেন্দ্রীয় নেতাকে কলকাতার সরকারি হাসপাতালের আবাসন থেকে সস্ত্রীক প্রায় উচ্ছেদ করে ছেড়েছেন, তাঁর দলের প্রতি নমনীয়তার প্রশ্ন অবান্তর! সেলিম বরং বুদ্ধবাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ধর্নায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি নেননি। পরে জেনেছেন এসএমএস মারফত। আর দলের সিদ্ধান্ত, তিনি একা পাল্টাবেন কী করে? তখন তো উল্টো প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজেপি-বিরোধিতার ময়দান ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? তাই টিভি চ্যানেলে দলীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। বুদ্ধবাবুর তাড়নায় শেষ পর্যন্ত অবশ্য সক্রিয় হন সেলিম। বঙ্গ সিপিএমে তিনি বুদ্ধবাবুরই কাছের লোক বলে পরিচিত। তিরস্কার-পর্বকেও খোলা মনেই নিয়েছেন। দলের অন্দরে সেলিম এ দিন বলেছেন, “বুদ্ধদা যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে দলের নিচুতলায় ভুল বার্তা যাওয়া ঠেকিয়েছেন। আমার একার পক্ষে যে এখানে কিছু করার ছিল না, সেটা জানিয়েছি।” কিছুই প্রায় বলার সুযোগ না পেয়ে ইদানীং লোকসভায় তেমন সক্রিয় দেখায় না সেলিমকে। এ দিন আর তাঁকে সংসদে দেখাই যায়নি। দলের দার্জিলিং জেলা সম্মেলনে আজ, শনিবার যোগ দিতে হবে বলে দুপুরেই ট্রেনে চেপেছেন।
আর করুণাকরন? আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, “আমরা ধর্নায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দলে পরে আলোচনা করে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।” তাতে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ জোট টোল খেল না কি? করুণার জবাব, “সংসদের মধ্যে তো অন্যদের মতোই আপত্তি তুলছি।” বিরোধীদের আনা নিন্দা প্রস্তাবে সইও করেছে সিপিএম।
বস্তুত সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, এই ‘অন্যদের মতো’ চলতে গিয়েই করুণা বিপদ ডেকে আনছেন। রাজ্যসভায় যেখানে ইয়েচুরির লেখা খসড়ায় বাকি বিরোধীরা সই করছেন, সেখানে লোকসভায় কারাট-ঘনিষ্ঠ করুণা তৃণমূলের পিছনে দাঁড়াচ্ছেন! তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্প্রতি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নাকি করুণা বলেছেন, ‘আমাদের দলের নেতাদের মুখে আপনাদের সম্পর্কে সমালোচনা শুনতাম। কিন্তু আপনারা তো দেখছি খুবই ভদ্র!’ সিপিএমের একটি সূত্রের আরও বক্তব্য, লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে সিপিএমের কোনও সংসদীয় দলনেতা না থাকাতেই এত সমস্যা। ইয়েচুরি শুধু রাজ্যসভার দলনেতা। করুণা লোকসভার। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় লোকসভার স্পিকার হয়ে যাওয়ার পরে ইয়েচুরি ২০০৫ সালে প্রথম রাজ্যসভায় আসেন। সেই সময়ে
একটি পলিটব্যুরো বৈঠকে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ইয়েচুরিকে সংসদীয় দলনেতা করলে সমন্বয় রাখতে সুবিধা হবে। বসুর এক দিকে বসেছিলেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কারাট, অন্য দিকে হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ। কারাট যুক্তি দেন, দুই কক্ষের দু’জন নেতা থাকুক। বরং একটি সমন্বয় কমিটি তৈরি হোক। ইয়েচুরি যুক্তি দিয়েছিলেন, সুন্দরাইয়া থেকে সমর মুখোপাধ্যায়, অনেকেই সংসদীয় দলনেতা হয়েছেন। পাল্টা প্রশ্ন উঠেছিল, ইয়েচুরি কি নিজেকে তাঁদের সমকক্ষ ভাবছেন! ন’বছর আগের সেই বিবাদের এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। উল্টে, করুণাকরনদের করুণ কাহিনি মধ্যরাতে সামাল দিতে হচ্ছে!
সোমনাথ, বাসুদেব আচারিয়াদের বিদায়ের পরে সেলিমের নামই এ বার লোকসভার দলনেতা হিসাবে সুপারিশ করে পাঠিয়েছিল আলিমুদ্দিন। সেলিমের নাম কেটে এ কে গোপালনের জামাই করুণাকরনের নাম বসিয়ে দিয়েছিলেন পলিটব্যুরোয় কেরলের নেতারা! মাস ছয়েকের মাথায় প্রথম রাতে সুযোগ পেয়েই বেড়াল মেরে দিলেন বুদ্ধদেব!
বকলেন সেলিমকে। সবক শেখালেন করুণাকরনকে। এবং সম্ভবত কারাটকেও!