উত্তরপ্রদেশে ভোটের উত্তাপ বাড়তেই ফের ‘রাম’ বেরিয়ে এল বিজেপির ঝুলি থেকে।
বিজয়া দশমীর দিন ভোটমুখী উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনউতে দাঁড়িয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন তাঁর বক্তব্যের শুরু ও শেষে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলেছিলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ভোটের মুখে উত্তরপ্রদেশে রামকে ফিরিয়ে এনে মেরুকরণের পথে হাঁটতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব। এ বারে আরও এক ধাপ এগিয়ে অযোধ্যায় রামের বিতর্কিত ‘জন্মস্থলে’র অনতিদূরে রামায়ণ সংগ্রহশালা বানাতে উদ্যোগী হল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। আগামিকাল সেই সংগ্রহশালার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে নিজের সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মাকে অযোধ্যায় পাঠাচ্ছেন মোদী। ভোটের মুখে বিজেপির মুখে ফের রামনাম নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই রাজনীতির তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। আর সেটিকে আরও চড়া দাগে উস্কে দিতে মোদী সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ বার রামমন্দির নির্মাণ নিয়েও ফের সরব হতে শুরু করেছেন। এই পরিস্থিতিতে দলের কৌশল রচনায় আজ সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকে বসেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, সরকারে মোদীর সেনাপতি অরুণ জেটলি, রামলালার কৌঁসুলি তথা কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ।
রামায়ণ সংগ্রহশালা বস্তুটি কী?
মহেশ শর্মা বলছেন, ‘‘এর মধ্যে রাজনীতির লেশমাত্র নেই। ভারত-সহ প্রতিবেশী দেশগুলিতে (নেপাল, শ্রীলঙ্কা) যেখানে রামায়ণের প্রভাব পড়েছে, সেই স্থানগুলি অন্তর্ভুক্ত করে একটি বৃহত্তর পর্যটন সার্কিট গড়ে তোলাই সরকারের লক্ষ্য।’’ তারই অঙ্গ হিসেবে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানের কাছেই ২৫ একর জমিতে রামায়ণ সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া রামকে নিয়ে অযোধ্যা বা চিত্রকূটে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। বিশ্বের ১২টি দেশের প্রতিনিধির সেখানে যোগ দেওয়ার কথা।
বস্তুত বিতর্কিত রামজন্মভূমি মামলাটি এ বছরের মধ্যেই আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। তাঁর দাবি, এর পর অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণেও আর কোনও সমস্যা থাকবে না। কারণ বিরোধী দলগুলি তো বটেই, সংখ্যালঘু ‘বন্ধু’রাও আলোচনার মাধ্যমে সেখানে রামমন্দির নির্মাণের কথা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তা হলে সেই আইনি নিষ্পত্তির আগেই তড়িঘড়ি সংগ্রহশালা গড়ার উদ্যোগ কেন? মহেশ মুখে যতই এর মধ্যে রাজনীতি নেই বলে দাবি করুন, বিজেপি শিবিরের খবর কিন্তু অন্য। দলীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, একে তো আড়াই বছরেও ‘আচ্ছে দিন’ নিয়ে আসতে ব্যর্থ মোদী সরকার। তা নিয়ে রোজ উঠতে বসতে বিরোধী থেকে সাধারণ মানুষের কটাক্ষ শুনতে হয়। অর্থনীতিরও চটজলদি ঘুরে দাঁড়ানোর তেমন কোনও লক্ষণ নেই।
অন্য দিকে, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে পুঁজি করে যে জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলা হচ্ছে সেই রসায়নও পুরোদস্তুর সফল নয়। গোয়ায় ব্রিকস সম্মেলনে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হিসেবে কোণঠাসা করার চেষ্টাও সফল হয়নি, উল্টে ইসলামাবাদের পক্ষ নিয়ে চিনের কড়া প্রতিক্রিয়ায় মোদীর সমস্যা বেড়েছে বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
অতঃপর? রামই ভরসা।
ফলে চেপে ধরেছেন বিরোধীরা। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে মায়াবতী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, মুজফ্ফরনগর-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গোষ্ঠী সংঘর্ষ লাগিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছে বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টি। উভয়ের ম্যাচ গড়াপেটায় ৮০টির মধ্যে ৭০টি আসন ঝুলিতে পুরে ক্ষীরটা খেয়ে নিয়েছিলেন অমিত শাহ। এ বারও বিতর্ক উঠতেই একযোগে বিজেপি-সপা’র আঁতাঁতকে কটাক্ষ করে মায়াবতী বলেছেন, ‘‘ভুললে চলবে না, যে রামায়ণ সংগ্রহশালা নিয়ে রাজনীতিতে নামছে বিজেপি তার জমি দিয়েছে অখিলেশ সরকারই।’’ দক্ষিণ থেকে সুর চড়িয়েছেন ডিএমকে নেতা করুণানিধিও। তাঁর কথায়, ‘‘ভোট এলেই রাম নিয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়ে বিজেপি নেতৃত্ব।’’ কংগ্রেস নেতা আরপিএন সিংহ বলেন, ‘‘ভোটের মুখে বিজেপির এই রামনাম করায় আমরা বিস্মিত নই। প্রত্যেক পাঁচ বছর অন্তর এই একই নাটক বিজেপি মঞ্চস্থ করে থাকে। কখনও রাম বলে, কখনও রামমন্দির বলে কখনও বা রাম সংগ্রহশালা বলে।’’ বিজেপি নিজে অবশ্য আশাবাদী— এই মেরুকরণের রাজনীতিতে নরম হিন্দুত্ব নিয়ে এঁটে ওঠা মুশকিল রাহুল গাঁধীর। ফলে এক দিকে জাতীয়তাবাদ ও অন্য দিকে রামের প্যাকেজ— দু’টিই বিজেপি সমান তালে ব্যবহার করতে চাইছে।
মুরলীমনোহর জোশী প্রথম এনডিএ আমলে যখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তখন রামকে নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছিল। রামকে কেন্দ্র করে শিক্ষায় গৈরিকীকরণের অভিযোগ ওঠে বাজপেয়ী সরকারের বিরুদ্ধে। আবার ইউপিএ সরকারে শিক্ষামন্ত্রী অর্জুন সিংহের আমলে ‘সহমত’-কে সঙ্গে নিয়ে রাম ও সীতাকে ভাই-বোন বলেও প্রচার হয়েছে। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মেনেছিলেন, দু’টি বক্তব্যই আসলে চরম মতাদর্শ।
এ বারে রামায়ণ সংগ্রহশালা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতেই তেড়েফুঁড়ে আসরে নেমে পড়েছেন বিজেপির অন্য নেতারা। মোদীর মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ শুনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া বলেছিলেন, ‘‘রামের নাম নিলেন যখন, এ বার রামের মন্দিরটাও তৈরি হোক।’’ আজ কট্টর হিন্দু মুখ বিনয় কাটিয়ার বলেন, ‘‘রাজ্যসভায় সংখ্যা না থাকুক, লোকসভায় সরকারের বিল পাশ করা উচিত। রামমন্দির নির্মাণ না হলে আমরা শান্তি পাব না।’’ বিজেপি নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতীর কথায়, ‘‘অযোধ্যার বিতর্কিত স্থলে রাম জন্মেছেন কি না তা নিয়ে আদালতে বিবাদ নেই। বিবাদ এটুকুই যে, ওই জমিটি ওয়াকফ বোর্ডের নাকি রাম জন্মভূমি ন্যাসের। রামের জন্ম নিয়ে আদালত আমাদের অবস্থান মেনেই নিয়েছে।’’
সব দেখেশুনে এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের প্রশ্ন, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নির্বাচনী রাজনীতির ছকটা পথটা কি তবে এক কথায়— রামায়ণ সংগ্রহশালা, লখনউয়ের গদি, রামমন্দির?