জয়ের পরে নীতীশ কুমার। ছবি: পিটিআই
লোকসভা ভোটের ফল দেখে দু’জনেরই প্রমাদ গুনেছিলেন। তার পর দীর্ঘ দ্বৈরথ সরিয়ে রেখে হাত মিলিয়েছিলেন পরস্পরের। সোমবার উপনির্বাচনের ভোটবাক্স খোলার পরে দেখা গেল, লালু প্রসাদ-নীতীশ কুমার যুগলবন্দি রুখে দিয়েছে বিজেপির জয়রথ। তাঁদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে কংগ্রেসও। ১০-এর মধ্যে ৬-৪ আসনে এই জোট হারিয়ে দিয়েছে বিজেপি-কে।
প্রায় একই ছবি কর্নাটকেও। দক্ষিণের এই রাজ্যে বিজেপির দীর্ঘদিনের শক্ত ঘাঁটি বল্লারী জিতে নিয়েছে কংগ্রেস। এবং তা-ও ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে। প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার ছেলে কোনও ক্রমে জিতে মুখ রেখেছেন বাবা এবং দলের। কিন্তু রাজ্যে কংগ্রেস বনাম বিজেপির ফল ২-১। পঞ্জাবেও বিজেপির জোট শরিক অকালি দলের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে কংগ্রেস। এখানে তাদের আরও আশার কথা, আমআদমি পার্টির ভোট অনেকটাই কমেছে। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হলেও একটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস।
অনেকে বলছেন, মোদী সরকারের একশো দিন উদ্যাপনে কাঁটার খোঁচা দিয়ে রাখল উপনির্বাচনের ফল!
লোকসভা ভোটে বিহারে ৪০টির মধ্যে ৩১টি আসনে জিতেছিল বিজেপি জোট। এর তিন মাসের মধ্যে বিহারে কী এমন হল যে, দৌড়ে পিছিয়ে পড়ল তারা? এই রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আর দেরি নেই। তার আগে এমন জয়ে এক দিকে যেমন লালু-নীতীশরা উজ্জীবিত, উল্টো দিকে রাজ্য বিজেপি নেতাদের চোখেমুখে হতাশা স্পষ্ট। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধৈর্য রাখতে পারেননি তাঁরা। মোদী ম্যাজিক কি শেষ এমন প্রশ্নের জবাবে স্পষ্টতই বিরক্ত সুশীলকুমার মোদী যেমন বলেছেন, সব কিছুতে নরেন্দ্র মোদীকে টেনে আনার মানে কী!
ঘটনা হচ্ছে, বিহারে যুযুধান সব পক্ষকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার পিছনে কিন্তু পরোক্ষে মোদী হাওয়াই দায়ী। লোকসভা ভোটে তাঁর নেতৃত্বে রাজ্যে বিজেপির জয়জয়কারের পরে রাজনৈতিক ভাবে বাধ্য হয়েই নিজেদের মধ্যে হাত মেলান জয়প্রকাশ নারায়ণের দুই শিষ্য। মিলনমঞ্চে ‘বড়েভাই’ লালুকে জড়িয়ে ধরেন নীতীশ। কংগ্রেস সেই স্রোতে মিশতে সময় নেয় ঠিকই, তবে শেষ পর্যন্ত তিন দল মিলে একযোগে বিজেপি বিরোধী ভোটের ভাগাভাগি রুখতে জোর কদমে নেমে পড়ে ময়দানে। এবং ফল বলছে, আপাতত তাঁরা সফল।
এই তিন দল এক জোট হলে যে বিজেপির থেকে বেশি ভোট পেতে পারে, সেটা লোকসভা ভোটের ফল দেখলেই বোঝা যাবে। সাধারণ পাটিগণিতই বলে দিচ্ছে, লালু, নীতীশ এবং কংগ্রেসের মোট ভোট ছিল ৪৫ শতাংশ। আর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র ছিল ৩৮ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনে ১৬ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট সামান্য হলেও ভাগ হয়েছিল। সেটা এ বার পুরোটাই ঢুকেছে লালু, নীতীশদের বাক্সে। কংগ্রেস জোটে আসায় সঙ্গে এসেছে উচ্চবর্ণের ভোটের কিছুটা অংশও। ভোটব্যাঙ্কের এই অঙ্ককে জাতপাতের রাজনীতি বলেই ব্যাখ্যা করছেন বিজেপির রাজ্য নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, লালু-নীতীশের জোট মানে সেই পুরনো মণ্ডল রাজনীতি। প্রথমে লালুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামাজিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয়টিকে সামনে রেখে ক্ষমতা দখল করলেও পরে নীতীশ এই জাতপাতের রাজনীতির উপরেই বেশি নির্ভর করতেন। তিনি বুঝেছিলেন, বিহারে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে এই পথে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দু’বছরের মধ্যে মহাদলিত উন্নয়ন পর্ষদও গড়েন তিনি।
বিজেপি নেতারা এ দিন প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও ঘরোয়া আলোচনায় দাবি করেছেন, কেন্দ্রে মোদী সরকারের বয়স একশো দিনও হয়নি। এর মধ্যেই হাওয়া পুরোপুরি ঘুরে গিয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই। তাঁরা মনে করছেন, বিধানসভার উপনির্বাচনে নানা ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করে। ভোটের অঙ্ক আর জাতপাতের রাজনীতি তো রয়েছেই। তেমনই এই ভোটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে স্থানীয় সমস্যাগুলিও। এ ক্ষেত্রে তার অন্যথা হয়েছে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই।
রাজ্য বিজেপির গোষ্ঠী কোন্দল তো আছেই। অন্তর্কলহে বিজেপি এ বারে হারিয়েছে ভাগলপুর এবং ছপরার মতো আসন। ১৯৬৭ সাল থেকে আরএসএসের মূল ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ভাগলপুর ’৯০ সাল থেকে ছিল বিজেপির হাতে। এ বার লোকসভা ভোটে এই লোকসভা আসনটি হারলেও ভাগলপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৩৫ হাজার ‘লিড’ পেয়েছিলেন শাহনওয়াজ হুসেন। এ বার প্রাক্তন বিধায়ক অশ্বিনী চৌবের পছন্দের প্রার্থী টিকিট পাননি। ফলে উস্কে উঠেছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। একই ভাবে বিক্ষুব্ধ বিজেপি প্রার্থীর জন্য হাতছাড়া হয়েছে ছপরাও।
এই ভোটের ফল যে তাঁদের কাছে বড় শিক্ষা, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিজেপি নেতারা। শাহনওয়াজ হুসেন থেকে সুশীল মোদী, সকলেই মানছেন, সামনে বিধানসভা ভোটে অপেক্ষা করছে কঠিন লড়াই।
আর নীতীশ? লোকসভা ভোটের ফল বেরোনোর পরে তাঁর ইস্তফার দাবিতে সরব ছিল বিজেপি। এ বার ভোট প্রচারেও ‘জঙ্গলরাজ’ আখ্যা দিয়ে জেডিইউ জমানাকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন সুশীল মোদীরা। এ দিন হাসি মুখে সে সব কথাই বলছিলেন নীতীশ। বলছিলেন, “তখন অনেকে আক্রমণ করেছিল। এমন ভাষা ব্যবহার করেছিল, যা বিহারের রাজনীতির পরম্পরা বিরোধী।” ইস্তফার দাবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে জিতনরাম মাজিকে কুর্সিতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই চালও কাজে দিয়েছে বলে মনে করছেন জেডিইউ নেতারা। এ দিন সুযোগ বুঝে নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি নীতীশ। নাম না-করে বলেন, “দিল্লিতে বসে অহঙ্কারী নেতারা ভেবেছেন, এটাই শেষ ভোট। এমনকী, রাজ্যসভার ভোটেও বিজেপি নোংরা রাজনীতি করেছে। মানুষ তার জবাব দিয়েছে।” এ দিনের ফলকে তিনি বলেছেন, “সদ্ভাবের জয় ও উন্মাদের পরাজয়।”
মুম্বইয়ের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লালু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে লিখেছেন, ‘লোকসভা নির্বাচনের ভুল শুধরে নিয়েছেন দেশের মানুষ’।
এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছে বিহারের রাজ্য রাজনীতিতে? জোটের এই সদ্ভাব বিধানসভা ভোট পর্যন্ত থাকবে তো? যে ভাবে লালুর দলের বাড়বাড়ন্ত দেখা দিচ্ছে, তাতে তাদের সব দাবিদাওয়া মেনে নিতে পারবেন তো নীতীশ? রাজ্য বিজেপি-ও সে দিকে তাকিয়ে।