‘ছাপান্ন ইঞ্চি’ ছাতির সশব্দ প্রদর্শন বিজেপিকে হয়তো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু মায়ানমারে জঙ্গি-অভিযান নিয়ে বিজেপি তথা সরকারের এই ঢক্কানিনাদ আন্তর্জাতিক অস্বস্তিই ডেকে আনল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
মণিপুর ও নাগাল্যান্ড ঘেঁষা মায়ানমারের ভূখণ্ডে অভিযান শেষ হতে না হতেই বিষয়টিকে কার্যত রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার করে মাঠে নেমেছিলেন বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী, প্রকাশ জাভড়েকর, রাজ্যবর্ধন রাঠৌরেরা। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, বিষয়টির স্পর্শকাতরতার কথা মাথায় না রেখে এই ‘বুক বাজানোয়’ আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রমশ তাপমাত্রা বেড়ছে। যার নজির, মায়ানমার এই অভিযানের ব্যাপারে প্রথমে ভারতের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বললেও পরে সরকারি ভাবে অস্বীকার করে। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চিন। বিষোদ্গার করছে পাকিস্তানও। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ঘরোয়া ভাবে কিন্তু বলছে, এই গোপন অভিযানের শেষে এমন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ছিল। তবে আজ ঘটনার গুরুত্ব আঁচ করে ক্ষত মেরামতির পথে হেঁটেছে বিজেপি। দলের মুখপাত্র সঞ্জয় কল আজ টুইট করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি নিয়ে নীরব থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারতের সব শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দেওয়া হবে মায়ানমার অভিযান নিয়ে চুপচাপ থাকতে। নৈঃশব্দ ধ্বনির থেকে শক্তিশালী।’’
অসমে এক সাংবাদিক বৈঠকে উত্তর-পূর্ব উন্নয়নমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহও এ নিয়ে মুখ খোলেননি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই। তবে সীমান্তে সেনা অভিযানে স্পষ্ট হয়েছে, ভারত যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘চাণ্ডেলে জঙ্গিদের যৌথ সংগঠন যে ভাবে সেনাবাহিনীর উপরে আক্রমণ চালিয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক।’’
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, বিজেপি-র এই বোধোদয় ঘটেছে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে। দলীয় মুখপাত্র চুপ থাকার বার্তা দিলেও আজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন। একটি অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাকিস্তানের নাম না করে জানাচ্ছেন, যারা ভারতের এই অভিযানে ‘শঙ্কিত’ তারাই প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। বিষয়টি এমনও নয় যে দু’টি জঙ্গি ঘাঁটি নিকেশ করে ওই অঞ্চলে ভারত-বিরোধী সামগ্রিক সন্ত্রাসবাদকে উৎখাত করে দেওয়া সম্ভব হল— এমনটা মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় কর্তারা এ কথা ভাল করেই জানেন যে এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী লড়াই। এক ভোররাতের অভিযানে যা সামগ্রিক ভাবে জিতে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ধরনের অভিযানে যেটা প্রয়োজন, সেটা হল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নিজেদের রণকৌশল পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত করে যাওয়া এবং কাজ সমাধা হলে তা যথাসম্ভব আড়াল করে রাখা। তার কারণ মূলত দু’টি। চূড়ান্ত গোপনীয় এই অভিযানের ধরনধারণ সম্পর্কে অতিরিক্ত চর্চা করলে পরবর্তী সময়ে সতর্ক হয়ে যেতে পারে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি। দুই, প্রতিবেশী দেশ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে মিশ্র সঙ্কেত যেতে পারে। বন্ধুভাবাপন্ন নয়, এমন রাষ্ট্রগুলি জেগে উঠতে পারে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ভুটানে বাজপেয়ী সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৩০টি ঘাঁটিতে যখন অভিযান চালিয়েছিল, তা নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেনি কেন্দ্র বা শাসক দল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে শুধু যেটুকু সাংবাদিক বৈঠক করার কথা, সেটুকুই করা হয়েছিল মাপা শব্দে। সেই প্রশাসনিক পরিণতিবোধ এ যাত্রায় দেখা গেল না বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
মায়ানমারের জঙ্গল থেকে বারুদের গন্ধ মেলানোর আগেই প্রকাশ জাভরেকর বলে বসলেন, ‘‘সব জঙ্গি সংগঠনের এই ঘটনা
থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। এটা বোঝা উচিত নিজেদের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে গিয়েও জঙ্গিদের সবক শেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত নয় ভারত।’’ তিনি যেখানে শেষ করলেন সেখান থেকে শুরু করলেন রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর। তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, মায়ানমারে যা হয়েছে তা ভারতের পশ্চিম সীমান্তেও ঘটতে পারে! গডকড়ীও সাংবাদিকদের জানালেন, মোদী সরকার ‘জিরো টলারেন্স’-এ বিশ্বাসী।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই সব ঘটনায় আক্রমণকারী দেশ তথা সরকারকে থাকতে হয় প্রচারের আলোর পিছনে আপাত অদৃশ্য ভাবে। এটাও হিসেবের মধ্যে রাখা উচিত যে অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পক্ষে কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় যে তার জমিতে ঢুকে অন্য কোনও দেশ, নাশকতা বিরোধী অভিযান করছে। মায়ানমারের সঙ্গে নয়াদিল্লি যে গোপন সমঝোতা করে চলছিল, তাতে এমনিতে কোনও সমস্যা ছিল না। এই ঘটনায় মায়ানমার নিজেদের কৌশলগত লাভের হিসাবও কষে রেখেছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মোদী সরকারের রাজনৈতিক সৈন্যসামন্তরা হইচইয়ের পরে একাদিক্রমে প্রতিক্রিয়া জানায় চিন এবং পাকিস্তান। চিনের এই প্রতিক্রিয়া মায়ানমারের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ তাদের সঙ্গে সম্প্রতি নরম-গরম কূটনীতির মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে মায়ানমারকে। বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত ভাবে মায়ানামারের জুন্টা সরকারের চিনের উপর নির্ভরশীলতাও যথেষ্ট। এই সব চাপের জন্যই গত রাতে সরকারি ভাবে মায়ানমারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাদের মাটিতে কোনও অভিযান হয়নি! যা হয়েছে তা সীমান্তের ও পারে ভারতীয় ভূখণ্ডে। সন্দেহ নেই, এত ঢাকঢোল পেটানোর পরে মায়ানমারের এই প্রতিক্রিয়া সাউথ ব্লককে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।