নির্বাচনী প্রচারে নীতীশ কুমারের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি পিটিআই।
আগে তিনি বলতেন, ‘‘আমাদের (সুশীল) মোদী রয়েছে, বাইরে থেকে আবার এক (নরেন্দ্র) মোদীকে প্রচারে আনার কী প্রয়োজন!’’ আজ সেই তিনিই যৌথ প্রচারের মঞ্চে নিজের বক্তব্য কাটছাঁট করে মাইক তুলে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা নির্বাচনের আগে এনডিএ-র সমন্বয় কমিটির কাছে দফায় দফায় জেডিইউ প্রার্থীদের ‘এসওএস’ যাচ্ছে, প্রচারে আরও বেশি করে নরেন্দ্র মোদীকে চাই। না-হলে সমূহ সর্বনাশ। সব মিলিয়ে এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা নীতীশ কুমারের পায়ের তলার জমি সরে যাচ্ছে ফি-দিন।
নীতীশের নিজের খাসতালুকেই পাড় ভাঙার ছবি স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী পৈতৃক এলাকা বাঢ়ের বাসিন্দারাই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে সরকারের উন্নয়ন নিয়ে। বাঢ়ের এক ধাবায় আলাপ ব্যবসায়ী আশিসের সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, “প্রথম পাঁচ বছরে তা-ও সড়ক, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহের কিছু কাজ হয়েছিল। তার পরেই সব তালগোল পাকিয়ে গেল। রোজগারের কোনও দিশা দেখাতে ব্যর্থ নীতীশ।’’ তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও চড়েছে গত ছয়-আট মাসের লকডাউনে। ধাবার মালিক দীপক যাদবের কথায়, “সরকারের উচিত ছিল আমজনতার জন্য কিছু করা। কিন্তু নীতীশ সরকার হাত গুটিয়ে বসে ছিল। ফলে লোকে আরও খেপে গিয়েছে।’’ বর্ষীয়ান দীপকের পর্যবেক্ষণ, ‘‘লালুপ্রসাদের শাসনের শেষ পর্বে মানুষকে এমন তিতিবিরক্ত দেখেছিলাম।’’
আরও পড়ুন: ভোটের বিহারে আজ দ্বৈরথে মোদী-রাহুল
অথচ, দু’মাস আগেও নীতীশ বিনা গীত নাই পরিস্থিতি ছিল বিহারে। নীতীশকে ছাড়া কাকে ভোট দেব— এই হাওয়া ঘুরে গিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, নীতীশকে কেন ভোট দেব? ভাবগতিক সুবিধের নয় দেখে জোটসঙ্গীর থেকে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। নিঃশব্দে বসে গিয়েছেন উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিহার বিজেপির শীর্ষনেতা সুশীল মোদী। সরকারি কারণ, করোনা সংক্রমণ। বিজেপির সঙ্গে এ দফার জোটে গোড়ার দিন থেকে ঝামেলা হচ্ছে জেডিইউ-এর। বিশেষ করে নীতীশের মুসলিম তোষণ নীতি নিয়ে আপত্তি ছিল গিরিরাজ সিংহের মতো কট্টর বিজেপি নেতাদের। কিন্তু সংখ্যার দর্পে তাঁদের গ্রাহ্য করেননি নীতীশ। সরকার চালানোর খাতিরে তখন বড় শরিকের ছড়ি ঘোরানো মেনে নিলেও, এ বার নীতীশ প্যাঁচে পড়তেই কার্যত একলা চলছে বিজেপি। রাজ্য সরকারের বদলে কেন্দ্রের মোদী সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেই প্রচারে নেমেছে তারা। যেমন, পুলওয়ামা, বালাকোট, রামমন্দির, ৩৭০ ধারা। বিজেপির এক নেতার কথায়, “দেশাত্মবোধ ও হিন্দুত্ব এই দুই অস্ত্রেই ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া দল।’’
মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা বেহাত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে কোনও ভাবে জোড়াতালি দিয়ে সরকার গড়েছে বিজেপি। লকডাউনের পরে প্রথম নির্বাচন হচ্ছে বিহারে। ক্ষমতাসীন রাজ্যে হেরে গেলে তার প্রভাব পড়বে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের উপর। বিশেষ করে প্রশ্ন উঠতে পারে লকডাউন নীতির যৌক্তিকতা নিয়ে। তাই যে কোনও মূল্যে বিহার জিততে চান মোদী-শাহ জুটি। বিহারের ২৪৩টি আসনের মধ্যে ১২২টিতে জেডিইউ এবং ১২১টিতে লড়ছে বিজেপি। পরিস্থিতি যা, তাতে জেডিইউ খুব বেশি হলে ৫০ থেকে ৬০টি আসন জিততে পারে বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। ফলে বেশি আসনে জিতে নিজেদের বড় শরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ এ বার বিজেপির সামনে।
যদিও বিজেপি জানিয়েছে ফল যা-ই হোক এনডিএ জিতলে জোটের মুখ্যমন্ত্রী হবেন নীতীশ। কিন্তু অমিত শাহেরা ওই ঘোষণা করেছিলেন ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে। নীতীশের পরিস্থিতি যে এতটা খারাপ হবে, তখনও তা আন্দাজ করেননি বিজেপি নেতৃত্ব। জেডিইউ-এর ফল যদি অস্বাভাবিক খারাপ হয়, তা হলে বিজেপি প্রতিশ্রুতি রাখবে কিনা, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। জেডিইউ নেতারা মনে করছেন, সে ক্ষেত্রে নীতীশ বিজেপির দয়ায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বলে বিরোধীরা যেমন প্রচার করবে, তেমনই তাঁকে চাপে রাখার সুযোগ পাবে বিজেপি।
আরও পড়ুন: মোদী-চিনফিং তিন বার দেখা হবে নভেম্বরেই
কংগ্রেস সাংসদ শক্তিসিং গোহিন এ বার বিহারের দায়িত্বে। নালন্দা এলাকায় আরজেডি প্রার্থীর প্রচারে এসেছিলেন তিনি। তাঁর মতে, “আরজেডি নেতা তেজস্বী ও কংগ্রসের মহাজোট পথে নামতেই বিহারবাসী বিকল্পের খোঁজ পায়। নীতীশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। প্রমাদ গোনে বিজেপি। তার পরেই চিরাগকে নীতীশের বিরুদ্ধে খাড়া করে তারা।’’ গোহিনের দাবি, চিরাগের আগুনে নীতীশের লঙ্কায় অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে চাইছে বিজেপি। তাঁর যুক্তি, জেডিইউ যে ১২২টি আসনে লড়ছে তাতে প্রার্থী দিয়েছে চিরাগের দল এলজেপি। যার অর্থ, বকলমে ২৪৩টি আসনে লড়ছে বিজেপি। বিজেপি-চিরাগ সরকার গড়ার ধারেকাছে পৌঁছলে নীতীশ এক কোণে পড়ে থাকবেন।