গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
উত্তরে যখন শুধুই ‘রামায়ণ’, দক্ষিণে উলটপুরাণ। উপলক্ষ— রামমন্দিরের সূচনা। তাই রামকে নিয়ে উন্মাদনা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই গড্ডলিকা স্রোতের বাইরে রাবণপ্রশস্তিতে উপচে পড়েছে তামিল টুইটার। #রামমন্দির, #অযোধ্যা— এমন সব টপিক যেমন ট্রেন্ডিং-এ ছিল, তেমনই ‘#তামি'লস প্রাইড রাবণ’ টপিকও ছিল। রাবণের পক্ষে ব্যাট ধরে কেউ শক্তিশেল ছুড়েছেন, তো কেউ ঘণ্টা, শঙ্খ, উপহারপাত্র ছুড়ে মারার উপক্রম করেছেন। আবার সেই সব টুইটের নীচে রামভক্তরাও পাল্টা ব্রহ্মাস্ত্র, গান্ধর্বাস্ত্র ছেড়েছেন। আর এসব দেখে অনেকেই বলছেন, এ যে রাম-রাবণের ‘ভার্চুয়াল যুদ্ধ’!
কেন রাবণ বেশি মহান? একাধিক যুক্তি সাজিয়েছেন রাবণপুজারী তামিল নেটাগরিকরা। কেউ বলছেন, দশানন রাবণ সীতাকে হরণ করেছিলেন বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে। দীর্ঘদিন তাঁর কব্জায় থাকা সত্ত্বেও সীতাকে ছুঁয়েও দেখেননি। বলেছিলেন, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সীতাকে ছোঁবেন না। অর্থাৎ নারীর সম্মান ও সম্ভ্রমকে রাবণ কতটা শ্রদ্ধা করতেন, সেই দিকে ইঙ্গিত করে কানিমোঝি মনোহরণ নামে এক তরুণী টুইটারে লিখেছেন, ‘‘রাবণকে নিয়ে উৎসব করার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট।’’
আর এক টুইটার ইউজার আবার এখান থেকেই লঙ্কাধিপতিকে মহান করে তোলার রসদ খুঁজে পেয়েছেন অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘‘রাবণ সীতাকে হরণ করলেও তাঁকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু আপনাদের রাম সেই সীতাকেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিলেন। এটাই কি রামের কাজ? সেই কারণেই আমরা রাবণকে সব সময় প্রশংসা করি।’’
আরও পড়ুন: ‘রামজন্মভূমি মুক্ত হল’, ১৫ অগস্টের সঙ্গে তুলনা টানলেন মোদী
এই সব যুক্তি ছাড়াও রয়েছে মতামতের বন্যা। কেউ বলছেন, রাবণ শিবভক্ত ছিলেন, তা ছাড়া তিনি ব্রাহ্মণ। কেউ আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, ‘‘যেখানে রাবণ রাজত্ব করতেন, সেই সিংহলে রামের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ও বীরপুজ্য ছিলেন রাবণ। তা হলে কেন রাম-রাজত্ব মানেই ভাল রাজত্ব, আর রাবণের শাসন মানেই কেন খারাপ বলব?’’ কট্টর এক রাবণভক্ত আবার আরও এক কদম এগিয়ে টুইট করেছেন, ‘‘ভারত রাবণের দেশ। সেখানে রামের কোনও স্থান নেই।’’ এছাড়া তামিল ভাষাতেও অনেকে একই রকম ভাবে রাবণের গুণগান করেছেন।
কিন্তু পাল্টা আক্রমণেও ভরপুর টুইটার। ভূমিপুজার মাধ্যমে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা উপলক্ষে দিনভর রামকেন্দ্রিক টপিক তো শীর্ষে ছিলই, তার পাশাপাশি অনেকে আবার এই রাবণ-প্রশস্তিকারীদের আক্রমণ, কটাক্ষও করেছেন। এক টুইটার ইউজারের খোঁচা, ‘‘তামিল'স্ প্রাইড রাবণ! সত্যি? তাহলে শুনুন, রাম আপনাদের গর্বকে হত্যা করেছিলেন। রাম এবং তাঁর ছোট্ট সেনাবাহিনী আপনাদের তথাকথিত রাবণের বংশ ধ্বংস করেছিলেন। বোকারা আরও শুনুন, রাম ভগবান বিষ্ণুর অবতার। আর রাবণ বিষ্ণুর দ্বাররক্ষীর অবতার।’’
আরও পড়ুন: নবযুগের শুরু, বললেন মোহন ভাগবত, রুপোর ইট গেঁথে সূচনা রামমন্দিরের
তবে এর মধ্যেও এক দল ছিলেন, যাঁরা নিরপেক্ষ বা মাঝামাঝি। দু’পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধনের চেষ্টাও করেছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের কথায় যে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যুযুধান প্রতিপক্ষের বাহিনী, তেমন নজির পাওয়া যায়নি। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত তামিল টুইটারে রাম-রাবণের যুদ্ধে এগিয়ে ছিলেন রাক্ষসরাজই।
পর্যবেক্ষকদের একাংশ আবার এর মধ্যে রাজনীতির সুক্ষ বাতাবরণও খুঁজে পেয়েছেন। তামিলনাড়ু শুধু নয়, কর্ণাটক বাদ দিলে পুরো দক্ষিণ ভারতেই বিজেপির ভিত এখনও তেমন কিছু নয়। তাই যে কোনও বড় কর্মসূচিতেই মোদী তথা গেরুয়া শিবির বিরোধী হাওয়া তোলার চোরাস্রোত চলতে থাকে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। রাবণের মাহাত্ম্য প্রচারের আড়ালে সেই কৌশলও কাজ করেছে বলে মনে করছেন একাংশ।