অযোধ্যা নগরী এখন অযোধ্যা ধাম। ছবি: পিটিআই।
অযোধ্যা নগরী এখন অযোধ্যা ধাম। নতুন স্টেশন, নতুন নতুন ট্রেন, বিমানবন্দর— সাজগোজের অন্ত নেই। এগিয়ে আসছে মন্দির উদ্বোধনের দিন। তবে এখনও শহরের রূপটান শেষ হয়নি। রাস্তার পাশে ফুলগাছ লাগানো চলছে এখনও। আলোয় রাম, হনুমান। তবে ফৈজাবাদ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত সব বাড়ি আর হোটেলের ছাদে গেরুয়া পতাকা উঠে গিয়েছে। কোথাও রাম, কোথাও হনুমানের ছবি। জমজমাট নয়াঘাট এলাকা। মোড়ের নতুন নাম হয়েছে ‘লতা মঙ্গেশকর চক’। মস্ত বড় বীণা ঘিরে রামের কাটআউট। পাশেই পুলিশ চৌকির দেওয়ালে আঁকা লতার ছবি।
সৌন্দার্যায়ন আর উন্নয়ন নিয়ে বরাবরই উদ্যোগী যোগী আদিত্যনাথ। ‘মন্দির ওঁহি বনেগি’ স্লোগান সফল হওয়ার পরে মন্দিরনগরীরও সৌন্দর্য চাই। শুধু নতুন রামমন্দির নয়, এই শহরের পাড়ায় পাড়ায় মন্দির আর আশ্রম। সীতা, লক্ষণ, হনুমান, বাল্মীকি, তুলসীদাস— সকলের মন্দির রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের আখড়া। সে সব নয় ভক্তের দানে চলে যাবে। কিন্তু এই শহর ঘিরে বাসিন্দাদের আয়ও তো বাড়াতে হবে! না হলে ভোট বাড়বে না। যোগীর সেই লক্ষ্যের কথা বিজেপি থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতাদের মুখে মুখে ফিরছে।
তবে উন্নয়ন নিয়ে অযোধ্যায় দু’রকম মত। যোগীর প্রতি ভয় আর ভক্তি দুই-ই সমান। রাস্তাঘাট চওড়া করতে গিয়ে অনেক দোকান ভাঙা পড়েছে। এখন দেশ-বিদেশের পর্যটক আসবেন। তাই হকার উচ্ছেদও করতে হয়েছে। আগে হনুমানগড়ির রাস্তা ছিল সরু। দিনরাত যানজট লেগে থাকত। এখন চওড়া দু’লেনের রাস্তা। যাঁদের দোকান ভাঙা পড়েছিল, তাঁরা ঘর পেয়েছেন। কিন্তু আগের মতো আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নয়। জায়গা কমেছে। তবে মেনে নিয়েছেন।
কয়েক মাস আগেও এই শহরের ‘লাইফলাইন’ ছিল টোটো। কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত। উদ্বোধন পর্বে অনেক রাস্তাতেই টোটো নিষিদ্ধ। তার বদলে বিদ্যুৎচালিত সিটি বাস চালু হয়েছে শহরে। গোটা শহর ঘুরে চলেছে বাস। পর্যটকরাই বেশি চড়ছেন। ফলে ভাতে টান পড়েছে টোটোচালকদের। যাঁরা সরযূর পারে বা রাম কি পৌরির কাছে বসে থাকতেন সওয়ারি ধরবেন বলে। এখন রাস্তায় কোনও দোকান নেই, টোটোরও ভিড় নেই। সর্বত্র পুলিশের কড়া নজরদারি। চৌকিতে প্রহরারত পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর অক্ষয় জৈন বলছিলেন, ‘‘উদ্বোধন বলে নয়, এখান থেকে টোটো স্ট্যান্ড পাকাপাকি ভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে। যান নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি।’’
পাশেই চায়ের দোকানে কাজ করছিলেন ছোটেলাল। আগে রাম কি পৌরির কাছেই তিলকুট, বাদামচাক্তি-সহ বিভিন্ন সস্তা দামের খাবার বিক্রি করতেন। তিনি এখন চায়ের দোকানে কাজ নিয়ে নিয়েছেন। ছোটেলালের দাদা আগে টোটো চালাতেন। টোটো বন্ধ। দাদা এখনও ভাল কোনও কাজ পাননি। আপাতত রাস্তায় আলো লাগানোর ঠিকাদার সংস্থায় কাজ করছেন। দোকান হারিয়ে কষ্ট নেই? ছোটেলাল বললেন, ‘‘পুলিশ তো তুলে দিল! ভেবেছিলাম রাস্তার কাজ শেষ হলে আবার বসব। কিন্তু এখন বলছে আর বসা যাবে না।’’ তবে আয়ে খুব একটা টান পড়েনি। শুধু নিজের ব্যবসার স্বাধীনতা নেই। তবে যোগীর প্রতি ভক্তি রয়েছে। বললেন, ‘‘যোগীজি আমাদের জন্যই তো করছেন সব। রাস্তা ভাল হয়েছে। অনেক লোক আসবে রামজির মন্দির দেখতে। আর রামজি কাউকে নারাজ রাখেন না।’’
পুলিশেরও হাত-পা বাঁধা। হকারদের ছাড় দিতে পারছে না তারা। জেলা প্রশাসন তো বটেই, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যোগী কখন চলে আসবেন কেউ জানে না!
উচ্ছেদ নিয়ে আলোচনায় অবশ্য খুব সরব নয় অযোধ্যা। আপাতত তার উৎসবে মন। তবে কিছু কিছু চিন্তা রয়েছে। দেহাতি মানুষের ভিড় কমে যাবে না তো! তাঁরাই তো পতাকা থেকে প্যাঁড়ার আসল ক্রেতা। এসি ট্রেন আর বিমানে আসা পর্যটকরা থাকবেন দামি হোটেলে। ‘মিনারেল ওয়াটার’ ছাড়া অন্য কিছু কিনবেন কি?
কলেজপড়ুয়া পঙ্কজ মৌর্য অযোধ্যার আশরফি ভবনের কাছে বাবার বইয়ের দোকানে বসেন। নানা ভাষায় অযোধ্যার ইতিহাস আর রামকথার ধর্মীয় বই মূলত বিক্রি হয়। বাড়ি আবাস বিকাশ কলোনিতে। সদ্যস্নাতক পঙ্কজ বললেন, ‘‘ভবিষ্যতের কথা এখন থেকে বলা যাবে না। মন্দির হচ্ছে বটে। তবে আমার মনে হয়, এখানকার সাধারণ মানুষের জীবনে বড় কিছু বদল হবে না। কারণ, নতুন কিছুর বাজার তো এখানে হবে না। ওই প্রসাদের মিষ্টি, পতাকা, ফুল। সেটাই চিন্তার। দিল্লি, মুম্বই বা বিদেশ থেকে আসা লোক এ সব কিনবেন তো! না কি শুধু বোতলের জল?’’ পঙ্কজ আরও বললেন, ‘‘এখানে অনেক ধর্মশালা। রাস্তার দু’পাশে ভান্ডারা চলছে। এখন বেশি, তবে সারা বছরই কোনও না কোনও সংগঠন সেগুলো চালায়। কিন্তু সব তো বাইরে থেকে আসা দেহাতি ভক্তদের জন্য। অযোধ্যার গরিব মানুষ তো রোজ রোজ লাইনে দাঁড়াতে পারবেন না।’’
হাঁটতে হাঁটতে দেখা গেল, ভান্ডারার শেষ নেই। কোথাও পুরি, তরকারি, বোঁদে। কোথাও খিচুড়ি, আলুর দম বিলি হচ্ছে। লাইন দিয়ে শীতে জবুথুবু মানুষ। ‘নিঃশুল্ক সেবা’ হিসাবে চা, কফি, দুধও মিলছে। রানুপানি গুমটির কাছে রামরূপ অগ্রবালের ভান্ডারায় দেখা হল কৌশল্যাদেবীর সঙ্গে। তিনি দশরথ-পত্নী নন। তিন সন্তানের জননী স্বামীহারা কৌশল্যা লুচি বেলছিলেন আপন মনে। অনেক কষ্টে মুখ খুললেন। অস্পষ্ট অগোছালো শব্দে যা বললেন তাতে বোঝা গেল, এক ছেলে টোটো চালাতেন। তিনি ফুল বিক্রি করতেন চন্দ্রহরি ঘাটের কাছে। পসরা সাজানো আপাতত বন্ধ। বলতে গিয়ে কি কৌশল্যার চোখ ছলছল করে উঠল? না কি আঁচল দিয়ে উনুনের ধোঁয়া আড়াল করলেন? বুঝতে দিলেন না অযোধ্যার ‘মা’।