গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অনন্ত রায় এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফাইল চিত্র।
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশ থেকে রাজ্য ভাগের কয়েক ডজন আবেদন পড়ে রয়েছে কেন্দ্রের ঘরে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভায় রাজ্য ভাগের প্রস্তাব পাশ না হওয়া পর্যন্ত সে বিষয়ে কেন্দ্রের বিশেষ কিছু করার থাকে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অনন্ত রায় (মহারাজ) সম্প্রতি একাধিক বার বলেছেন, খুব দ্রুত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে কোচবিহার। দাবি করেছেন, তাঁকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এ নিয়ে নাকি প্রচারও করতে বলেছেন তাঁরা। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের একাংশের মুখেও বার বার শোনা গিয়েছে উত্তরবঙ্গের আলাদা রাজ্য হওয়ার কথা। অথচ দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সম্প্রতি একাধিক বার বলেছেন, রাজ্য ভাগ নিয়ে কোনও কথা এখনও পর্যন্ত ওঠেনি। তা নিয়ে কোনও নির্দেশও আসেনি দলের ‘উপর মহল’ থেকে। এই পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে যখন ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তখন শাহের মন্ত্রকের এ দিনের বক্তব্যকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতারাও বলছেন, দল ছোট রাজ্যের পক্ষে। কিন্তু রাজ্য ভাগের প্রশ্নে সেই রাজ্যের নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি তার বৃহত্তর জনমানস কী চাইছে, তা দেখেই পদক্ষেপ করার পক্ষপাতী দল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য ভাগের বিষয়টি এ দিন খোলসা করার পরে অনন্ত রায় এবং স্থানীয় বিজেপি নেতারা কী বলেন, সে দিকে নজর থাকছে রাজনৈতিক মহলের।
সম্প্রতি কামতাপুরি ভাষাকে অষ্টম তফসিলের আওতায় স্বীকৃত ভাষার মর্যাদা ও কামতাপুর রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়ে কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিল কামতাপুর প্রোগ্রেসিভ পার্টি। কিন্তু শাহের মন্ত্রক কামতাপুরি ভাষা সংক্রান্ত দাবি কার্যত খারিজ করে দেওয়ার পাশাপাশি রাজ্য গঠনের দাবিটি খতিয়ে দেখতে নিজেদের কেন্দ্র-রাজ্য বিভাগে পাঠিয়ে দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে আজ খবর, বিষয়টি নির্দিষ্ট সময়ে খতিয়ে দেখা হবে। ওই সূত্রের মতে, এ ধরনের রাজ্য ভাগের দাবি নিয়মিত কেন্দ্রের ঘরে জমা পড়ে। কিন্তু যখন রাজ্য ভাগ সংক্রান্ত প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভায় পাশ হয়ে কেন্দ্রের কাছে আসে, একমাত্র তখনই বিষয়টি গতি পায়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে এ ধরনের কোনও প্রস্তাব জমা পড়েনি। এখনও পর্যন্ত তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ঘোষিত অবস্থান পশ্চিমবঙ্গ ভাগের বিরুদ্ধেই।
নীতিগত ভাবে বিজেপি বরাবর ছোট রাজ্যের পক্ষে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানাতেই উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড ও মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তীসগঢ় হয়েছিল। অতীতে গোর্খাল্যান্ড প্রসঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছিল বিজেপির লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে। যদিও গত আট বছর কেন্দ্রে মোদী সরকার থাকলেও, রাজ্য (পশ্চিমবঙ্গ) ভাগের বিষয়টি সে ভাবে গতি পায়নি। যার প্রধান কারণ রাজ্য নেতৃত্বের বিরোধিতা।
বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানেন, বাংলা ভাগের সমর্থনে সরব হলে, সমতলে জনভিত্তিতে ধস নামবে। সে ক্ষেত্রে অধরাই থেকে যাবে বাংলার মসনদ দখলের স্বপ্ন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দলকে বাংলা ভাগ নিয়ে কোনও ‘সুচনা’ (নির্দেশ) এখনও দেওয়া হয়নি। বরং তাঁর অভিযোগ, রাজ্য ভাগের এই হাওয়া তোলার পিছনে তৃণমূলের পরিকল্পনা থাকলেও থাকতে পারে।
অনন্ত এ কথা মানতে নারাজ। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, সুকান্তের আদৌ রাজ্য ভাগ নিয়ে কিছু বলার এক্তিয়ার আছে কি না। তাঁর দাবি, “আমরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পেতে চলেছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সুকান্ত মজুমদার তো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি নন, ওই বিষয়ে তাঁর জানার কথা নয়।”
রবিবার রাজ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনশলের সঙ্গে বৈঠক করেন অনন্ত। বনশলও এ দিন বিষয়টি সুকান্তের দিকে ঠেলেছেন। সুকান্ত এ দিনও মালদহে দলীয় কর্মসূচি থেকে জানিয়েছেন, “রাজ্য ভাগের প্রশ্ন নেই। দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের অবস্থা ভাল নয়। তাই ওরা রাজ্য ভাগের কথা বলছে। আর অনন্ত মহারাজের বক্তব্য প্রসঙ্গে আমি কোনও কথা বলব না।”
তৃণমূলের কোচবিহার জেলার প্রাক্তন সভাপতি তথা রাজবংশী নেতা পার্থপ্রতিম রায়ের পাল্টা অভিযোগ, বিজেপিই আলাদা রাজ্যের বিষয়টি জিইয়ে রেখে রাজনীতি করতে চাইছে। তিনি বলেন, “বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা এক-এক সময়ে এক-এক রকম কথা বলছেন। যা বলার স্পষ্ট করে বলুন। তা হলেই আর ধোঁয়াশা থাকবে না। এ সব চালাকি মানুষ ধরে ফেলেছে।” অনন্তের অন্যতম ‘সঙ্গী’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি।