গোঁসামহলের পদযাত্রায় আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।
গুগ্ল ম্যাপ বলছে, এটাই সাইদাবাদ। ১০০ মিটার এগোলেই থানা। তার পাশেই আসতে বলেছিলেন সিরাজ। ১০টায় সভা শেষ করবেন ‘আসাদভাই’। তার পরে কথা হতে পারে। ব্যস, ওটুকুই।তার আগের পাঁচ দিনে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দু’টি মোবাইলে বেশ কয়েক বার ফোন করা হয়েছে। কেটে দিয়েছেন। এসএমএস করা হয়েছে। প্রতি বারই জবাব এসেছে, ‘এখন কথা বলতে পারছি না। পরে যোগাযোগ করুন।’ কিন্তু, ভোট কভার করতে হায়দরাবাদে এসে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির সঙ্গে দেখা করতে না পারাটা কোথাও একটা বিঁধছিল। কথাটা তাঁর জনসংযোগের কাজ দেখা তৌসিফ ভাইকে বলেছিলাম। তিনি পরামর্শ দিলেন, পদযাত্রা বা পথসভায় কোথাও একটা দেখা করে নিন। ভোটের এই সময়ে ‘আসাদভাই’কে ও রকম ভাবে পাওয়া যাবে না। কিন্তু, কোথায় কখন সভা, তার একটা তালিকা মিলবে? সেটাও দিতে পারলেন না তৌসিফভাই। শুধু একটা নম্বর দিয়ে বললেন, ‘‘সিরাজকে ফোন করে আমার কথা বলবেন। ও বলে দেবে কোথায় কখন যেতে হবে।’’সাইদাবাদ থানাটা পেরোতেই রাস্তাটা সরু হয়ে এল। পথের ধারের ভিড়টা রাস্তায় উঠে এসেছে। চোখে পড়ল ছোট্ট মঞ্চটাও। হাজার হাজার ওয়াটের আলোয় ঝলমল করছে। পিছনের পর্দায় লাগানো অসংখ্য সাদা-সবুজ ঘুড়ি। মোবাইল বলছে, সাড়ে আটটা। সভা শুরু হয়ে গিয়েছে। বক্সের আওয়াজে গমগম করছে গোটা এলাকা। পুরনো হায়দরাবাদের এই সাইদাবাদ এলাকা মালাকপেট বিধানসভার মধ্যে পড়ে। সেখানেই মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এমআইএম)-এর সভা।
প্রচারে বেরিয়ে ভোটারের আশীর্বাদ নিচ্ছেন আসাদউদ্দিন।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি কখন আসবেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড় সামলাচ্ছিলেন সাইদাবাদ থানার এসআই এস রেড্ডি। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হাতের ঘড়িটা দেখে বললেন, ‘‘এরা সভার জন্য ৭টা থেকে ১০ পর্যন্ত অনুমতি নিয়েছে। দেখুন, দলের সভাপতি কখন আসেন।’’ ছোট্ট একটা সভার জন্য এত পুলিশ! রেড্ডি হেসে বললেন, ‘‘এলাকাটা হিন্দু-মুসলিম মিক্সড। একেবারে ফিফটি ফিফটি।’’ বোঝা গেল আসাদউদ্দিনের সভা নিয়ে পুলিশও উদ্বেগে থাকে।সওয়া ন’টা। তত ক্ষণে গোটা রাস্তা ভিড়ে ঠাসাঠাসি। মঞ্চের ডান দিকে রাস্তার উপর কোনও রকমে ঠেলাঠেলি করতে করতে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভিড়টা মাঝে মাঝে ঢেউয়ের মতো দুলছে। তার মধ্যেই চিৎকার শুরু হয়ে গেল— ‘আসাদভাই জিন্দাবাদ’। ‘এমআইএম জিন্দাবাদ’। মঞ্চের বক্তা ভাষণ থামিয়ে দিলেন। একটা এসইউভি ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়াল। ফুলের মালায় সাজানো। কয়েক জন নামলেন বোঝা গেল। ভিড় পেরিয়ে তাঁরা এগোলেন মঞ্চের দিকে। ‘আসাদভাই’ এলেন? ভিড়ে ভাসিয়ে দেওয়া প্রশ্নের জবাব এল, ‘‘আরে না, না। ইনি আমাদের প্রার্থী আহমেদ বালালা।’’ উনি কখন আসবেন? ‘‘নেহি জানে ভাইয়া।’’ঠিক ন’টা পঁচিশ। ভিড়টা আবার দুলে উঠল। চিৎকারের মাত্রা আগের থেকে কয়েক গুণ।একটা বাইক হর্ন বাজাতে বাজাতে বেশ গতি নিয়ে ওই ভিড় চিরে ঠিক পাশে এসে দাঁড়াল। চালকের মুখ বোঝা যাচ্ছে না। কালো হেলমেটে ঢাকা। থামার আগেই পিছন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লেন এক জন। তার পর ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উঠে পড়লেন মঞ্চে। আর তখনই বোঝা গেল বাইকের পিছনে ছিলেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। যে ফিল্মি কায়দায় তিনি সভায় এলেন, ভাবাই যায়নি। যাঁর দলের বিধায়ক এসইউভি চড়ে সভায় আসেন, সেই দলের সভাপতি এলেন কিনা বাইকে! এবং কোনও কনভয় ছাড়াই!কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ন’টা। মঞ্চের সব আলো কেড়ে নিলেন তিনি। গাড় ধূসর রঙের শেরওয়ানি।সাদা পাজামা। মাথায় ফারের টুপি। পরিপাটি করে ছাঁটা ছুঁচালো দাড়ি। হাতে দামি ঘড়ি। দূর থেকেও বোঝা যায়, নামী ব্রান্ডের চশমা। পায়ে কালো জুতো। ঠিক যেমন ভাবে তাঁকে টেলিভিশনের বিতর্কসভাগুলোয় দেখা যায়। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভারী গলায় বললেন, ‘বিসমিল্লাহির রহ্মানের রহিম। সালাম ওয়ালেকুম...’। সামনের জনতা ‘ওয়ালেকুম সালাম’ চিৎকার করেই থেমে গেল। যেন কেউ তাদের অডিওটা ‘মিউট’ করে দিয়েছে!
মালাকপেটের জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।
উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাকের হত্যার ঘটনা দিয়ে শুরু করলেন। তার পর জুনেইদ খুন। তিন তালাক নিয়ে আদালতের রায় সম্পর্কিত মন্তব্য করেই সরাসরি চলে এলেন নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনায়। গোটা সভাতেই তাঁকে ‘মোডি’ বলে উচ্চারণ করলেন। এর পর বিজেপি, কংগ্রেস থেকে রাহুল গাঁধী, চন্দ্রবাবু নায়ডু থেকে টিডিপি— ছাড়লেন না কাউকে। চাঁচাছোলা উর্দুতে সেই শানানো বক্তব্য যখন রাখছেন আসাদউদ্দিন, আশপাশের জনতার মুখ তখন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। গোটা তেলঙ্গানা যখন তাঁর দলকে এমআইএম বলে উল্লেখ করে, এমনকি তাঁর দলের সদস্যরাও, আসাদ কিন্তু প্রতি বারই পুরো নামটাই উচ্চারণ করছেন, ‘মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’। এবং সেটা প্রায় প্রতিটি বাক্যেই। চোখটা মাঝে মাঝে বুজে রাখছেন। ঘাড় ঘোরানোর সময় বোঝা যায়, কারও দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না আসাদউদ্দিন। দৃষ্টি ভাসিয়ে রাখেন আসলে জনতার মধ্যে। টান টান ভাষণে প্রতিটা মুহূর্তেই তাঁর গলা আরও চড়া হচ্ছে। হাত নাড়ছেন ভীষণ সচেতন ভাবে।টানা অনেকটা বলার পর এক বার ঘড়ি দেখলেন আসাদউদ্দিন। সামনের জনতা উত্তেজনায় তখন প্রায় ফুটছে। বোঝা গেল, কেন পুরনো হায়দরাবাদের সব গলি, মহল্লা, দোকান, বাজার বলে, ‘আসাদভাই হামারা হিরো হ্যায়’। কেন বলে, ‘এমআইএম জিতছেই’। কেন পুরনো হায়দরাবাদের সাতটা আসনে আগের বারের মতো ‘মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ই জিতবে বলে আশা করে।ভাষণ যখন একেবারেই চড়ায়, হঠাৎ করেই আসাদউদ্দিন বললেন, ‘‘খোদা হাফিজ।’’ মোবাইলে দেখা গেল, ন’টা ঊনষাট! এতটাই মাপা!বক্তব্য শেষ করেই মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে এলেন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই আসাদউদ্দিন। ভিড়টা এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। তার মধ্যেই কোনও রকমে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে পৌঁছনো গেল একেবারে কাছে। আতরের সুবাস ওই ভিড়েও বেশ স্পষ্ট। ভিড় কাটিয়ে যে মিনিট চারেক লাগল তাঁর বাইকের কাছে পৌঁছতে, তার মধ্যেই কয়েকটা প্রশ্ন করা গেল। কী হবে রাজ্যের ফল? ‘‘গাড়ি চলতে রহেঙ্গে। ইঞ্জিন হম বনেঙ্গে।’’ মনে পড়ল, তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির প্রতীক সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। পরের প্রশ্ন করা গেল, কংগ্রেস তো ধর্মনিরপেক্ষ দল। তার উপরে এত রাগ কেন? চশমার ভিতর দিয়ে ওই ভিড়ের মধ্যেই তিনি যে ভাবে তাকালেন, তাতে স্পষ্ট, প্রশ্নটা না-পসন্দ। সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে দিলাম পরের প্রশ্ন। আপনার এই এককাট্টা বক্তব্য কোথাও বিজেপিকে সুবিধা করে দেয় না? কংগ্রেস তো বলে, আপনি বিজেপির বি-টিম। পাল্টা প্রশ্ন এল, ক’দিন আছেন হায়দরাবাদে? জবাব শুনে বললেন, ‘‘কাল সকালে ফোন করবেন, কথা হবে।’’তত ক্ষণে বাইকের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন আসাদউদ্দিন। বাঁ পা মাটিতে রেখে ডান পা উঁচু করে বাইকে বসতে বসতেই বললেন, ‘‘চলো সিরাজ।’’ভিড়টা তাঁকে ছাড়তে চাইছে না। তাঁর মধ্যেই পুরো পিকআপে সজোর গোঙানি তুলে বেরিয়ে গেল একক কনভয়ের একমাত্র বাইক।
ছবি: আসাদউদ্দিনের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া।