বিজেপির সদর দফতরে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। রবিবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
এখানে ভোট, না কি যুদ্ধ চলছে!
রাস্তার দু’দিকে যেন কালাশনিকভের মিছিল! জলপাই রঙের পোশাক পরা চেহারাগুলোর মাথায় বুলেটপ্রুফ হেলমেট। সঙ্গে স্নিফার ডগ। হাতে লম্বা আইইডি ডিটেক্টর। মাথার উপরে বায়ুসেনার কপ্টারের লাগাতার চক্কর।
জঙ্গলের বুক চিরে বস্তার থেকে নারায়ণপুরের রাস্তা। মাঝে মাঝে ছোট গ্রাম। বাকি রাস্তায় যেখানে টহলদারি বাহিনী নেই, সেখানে মাইলের পর মাইল ফাঁকা, শুনশান।
ভুল বললাম। শুনশান কোথায়? জঙ্গলের মধ্যে ঠাহর করলেই দেখা যাবে, পায়ে হাঁটা কাঁচা রাস্তায়, নালার পাশে, ছোট্ট সেতুর নীচে, রাস্তার ধারে গাছের ফাঁকে পাথরের উপরে জঙ্গলের দিকে মুখ করে একে-৪৭ উঁচিয়ে টানটান সিআরপি, বিএসএফ বা আইটিবিপি-র জওয়ান।
কড়া নজর: বস্তারে টহল আধাসেনার। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।
ওয়াকিটকিতে যান্ত্রিক বার্তা আসছে— সাত সকালেই কাঙ্কেরে অন্তাগঢ় বিধানসভা কেন্দ্রে ছ’-ছ’খানা আইইডি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মাওবাদীরা। কোলিয়াবেড়াতে বিএসএফের একটি বাহিনী টহলদারিতে বেরিয়েছিল। তখনই হামলা। বিএসএফের সাব-ইনস্পেক্টর মহেন্দ্র সিংহ গুর্জরকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। বিএসএপ সূত্রে জানানো হয়েছে, ঘরে সাত মাসের সন্তান রয়েছে মহেন্দ্রর। যাকে মাত্র একবারই চোখে দেখেছেন তিনি।
গত ১৫ দিনে মাওবাদীদের হামলায় এই নিয়ে ১৪ জনের মৃত্যু হল। ছত্তীসগঢ়ের স্পেশাল ডিজি (অ্যান্টি-নকশাল অপারেশনস) ডি এম অবস্থির হিসেব, “গত ১০ দিনে ৩০০-র বেশি আইইডি উদ্ধার হয়েছে।”
আরও পড়ুন: ভোট দেবে কে? যুদ্ধক্ষেত্রে আজ পরীক্ষায় গণতন্ত্র
সোমবার ছত্তীসগঢ় বিধানসভার প্রথম দফার ভোট। বস্তার, কাঙ্কের, সুকমা, দন্তেওয়াড়া, বিজাপুর, নারায়ণপুর, কোণ্ডাগাঁও এবং রাজনন্দগাঁও— ৮টি জেলার মাত্র ১৮টি আসন। তার মধ্যে ১৩টি আসনেই মাওবাদীদের দাপট। গোটা এলাকা জুড়ে মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে। তাদের ঠেকাতে ৬৫০ কোম্পানি আধাসেনা নেমেছে। সঙ্গে অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা ৬৫ হাজার পুলিশ। ১৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটের পাহারায় ১ লক্ষাধিক জওয়ান! রবিবারই বিজাপুরে মাওবাদীদের সঙ্গে বাহিনীর সংঘর্ষের পরে এক মাওবাদীর দেহ উদ্ধার হয়েছে। তার পরেও সেই মাওবাদীদের নিয়েই আতঙ্কে সব পক্ষ।
কিন্তু এত বাহিনী, এত ব্যবস্থা সত্ত্বেও ভোটের আগের দিন সকালে আধ ডজন আইইডি বিস্ফোরণ, এক জওয়ানের মৃত্যু। তা হলে কি নিরাপত্তায় ফাঁক?
সিআরপি-র টহলদারি বাহিনীর এক অফিসার ম্লান হাসলেন। “দু’দিকের জঙ্গল দেখছেন? ওর ভিতর থেকে ঘণ্টায় একটা হামলা হলেও কিছু করার আছে? রাস্তার পাশে কোথায় আইইডি, কোথায় ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখেছে, বোঝা সম্ভব?”
নারায়ণপুরের রাস্তায় বেনুরের তিনমাথার মোড়ের দোকানে এক লিটার জলের বোতলে ভর্তি পেট্রল বিকোচ্ছে। লিটার প্রতি ১০০ টাকা। রবিবার সকালে দাদার দোকান সামলাচ্ছে ক্লাস এইটের সুরেন চুরপাল। দোকানের উল্টো দিকে নারায়ণপুর জেলা পুলিশের বিরাট হোর্ডিং ‘জুর্ম, হিংসা ছোড়ো, শান্তি, বিকাশ সে নাতা জোড়ো’। মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান। মাওবাদী সংগঠনের কোন পদে থাকলে, আত্মসমর্পণের সময় কত টাকার পুরস্কার, এলএমজি, একে-৪৭ বা ইনসাস নিয়ে ধরা দিলে কত টাকা মিলবে, তার ঘোষণা।
আরও পড়ুন: মাওবাদী চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আজ প্রথম দফার ভোটে ছত্তীসগঢ়
মাওবাদীদের দাপট কি কমেছে?
পুলিশের টাঙানো হোর্ডিংয়ের ছবির দিকে আঙুল দেখায় সুরেন। মাওবাদীদের ৬টি কোম্পানির প্রাক্তন কম্যান্ডার সম্পতের হাসি মুখ সেখানে। আত্মসমর্পণ করেছেন কিছু দিন আগে। সুরেনের কথায়, “ও আমাদের গ্রামের লোক। আগে অ্যাকশন করত। এখন আর তেমন অ্যাকশন হয় না। সারা বছর স্কুল খোলা থাকে।”
মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহেরও তেমনই দাবি। তিনি মাওবাদী এলাকায় শান্তি ফেরাচ্ছেন। কিন্তু মাওবাদীদের দাপটে থাকা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতেই তো বিজেপি পিছিয়ে। ১৮টি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের দখলে এখন ১২টি।
আদিবাসীদের রাগ বিজেপির উপরে। অভিযোগ, ব্রাহ্মণ-ঠাকুরদের কথায় তফসিলি জাতি-জনজাতি নির্যাতন প্রতিরোধ আইন লঘু করে দিতে চেয়েছিল বিজেপি। গ্রামের চাষিরাও অসন্তুষ্ট। কথা মতো ধানের সহায়ক মূল্য মেলেনি। এই অবস্থায় ইস্তাহারে ১০ দিনের মধ্যে চাষিদের ঋণ মকুব, ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি ২৫০০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নজর কেড়েছে কংগ্রেস।
ক্ষমতায় ফিরতে হলে এই মাওবাদী, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় খেলা ঘোরাতেই হবে রমন সিংহ তথা বিজেপিকে। মহিলাদের জন্য শাড়ি, ছ’বাটির টিফিন বাক্স— এমন কত উপহার বিলি হয়েছে। বিজেপি অকাতরে নগদ ছড়াচ্ছে বলেও কংগ্রেসের অভিযোগ।
এ সবের পরেও শান্তিপূর্ণ ভোট নিয়েই চিন্তা। ভোট বয়কটের ডাক দিয়ে আসলে বাধা ওরা, মানে মাওবাদীরা। কালাশনিকভ দিয়ে ঠেকানো যাবে ওদের?
রাত পোহানোর অপেক্ষায় ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ বস্তার।