অনেকটা বলিউডি কায়দায় ফোনের ওপারে থাকা পুল শিবিরের এক বিধায়ক গত কাল গভীর রাতে বলেছিলেন, "কাহানি আভি বাকি হে দোস্ত। আগে দেখো কেয়া হোতা হ্যায়।"
প্রতি ছ'ঘণ্টায় পালা বদল ঘটা অরুণাচলের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তখন অবশ্যম্ভাবী রাষ্ট্রপতি শাসনের ছায়া। ১৬ জুলাই সকালে আস্থা ভোটে নাবাম টুকি হারছেন। কালিখো পুলরা সদলবদে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছেন। বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে- এটাই মোটামুটি নিশ্চিত ধরে নিয়ে সকলে তখন শনিবার সকালের অপেক্ষায়। কিন্তু ততক্ষণে গোপন শেষ চালটা চেলে দিয়েছে এআইসিসি। ভাঙন ধরেছে পুলের শিবিরে। পুল-পন্থী বিধায়কের ওই কথায় ছিল আজকের সেই নাটকীয় পট পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত। যে নাটকের ক্লাইম্যাক্সে পুল বা টুকি নয়, হিসেবে না থাকা পেমা খাণ্ডু অরুণাচল প্রদেশের দশম মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। 'কংগ্রেস-মুক্ত উত্তর-পূর্ব' গড়ার জন্য ধুমধাম করে 'নেডা' গড়েছিল বিজেপি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট টুকিকে স্বপদে বহাল করায় জোর ধাক্কা খায় তারা। আজকের তুখোর কূটনৈতিক চালে সেই স্বপ্নে আরও জল ঢেলে দিল কংগ্রেস।
আস্থা ভোট রুখতে চেয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে গত কাল হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নাবাম টুকি। সেই আর্জি খারিজ হয়ে যায়। গত কাল রাত পর্যন্তও স্পিকার নাবাম রিবিয়া বিধানসভা অধিবেশন তলব করেননি। এ দিকে আস্থা ভোটে টুকিকে হারাবেন বলে আত্মবিশ্বাসী পুলের সঙ্গে থাকা সিংহভাগ বিধায়কই হঠাৎ পুলকে গুয়াহাটিতে ফেলে চাওনা মেইনের নেতৃত্বে ইটানগর রওনা হয়ে যান। দলীয় সূত্রে খবর, ততক্ষণে এআইসিসি কালিখো পুলের সঙ্গে থাকা বিধায়ককে বার্তা দিয়েছে, সরকার ভাঙলে কারও লাভ হবে না। বরং, পুল গোষ্ঠীর দাবি মেনে সরানো হবে টুকিকে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হবেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দোর্জি খান্ডুর পুত্র পেমা খান্ডু।
রাত থেকে নতুন করে বৈঠক বসে ইটানগরে। আজ সকালে প্রত্যাশামতোই টুকি পদত্যাগ করেন। কংগ্রেস বিধায়কদের বৈঠকে হাজির হন অসহায় পুলও। কংগ্রেস বিধায়ক দলের নতুন নেতা হিসেবে পেমার নাম সমর্থন করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাঁর। ৫৮ সদস্যের বিধানসভায় ৪৪ জন কংগ্রেস ও দুই নির্দল বিধায়কের সমর্থন-সহ পেমা কার্যনির্বাহী রাজ্যপাল তথাগত রায়ের কাছে গিয়ে সরকার গড়ার আবেদন জানান। রাজ্যপাল জানান, পেমার দাবি খতিয়ে দেখে তিনি শপথ গ্রহণের তারিখ ও সময় জানাবেন।
কিন্তু হঠাৎ কেন ভোল বদল ডিসেম্বর থেকে কালিখো পুলের সঙ্গে থাকা বিধায়কদের? ১৩ জুলাই তাঁরাই বিজেপির নেতৃত্বে কংগ্রেস মুক্ত উত্তর-পূর্ব গড়ার জন্য 'নেডা'য় অংশ নেন। ১৪ জুলাই সকলে একজোট হয়ে গুয়াহাটির হোটেলে টুকিকে হারানোর শপথ নেন। কিন্তু ১৬ জুলাই তাঁরাই বিজেপির মুখ পুড়িয়ে কী ভাবে কংগ্রেসের সরকার গড়ায় শরিক হলেন?
নতুন মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু। নিজস্ব চিত্র।
পুল শিবিরে থাকা এক মন্ত্রীর স্পষ্ট কথা, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অরুণাচলের রাজনীতি এক করে দেখা ঠিক নয়। এখানে রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতি আর উপজাতির সমীকরণ বেশি শক্তিশালী। টুকির বিরোধিতা করে কংগ্রেস থেকে ৩০ জন বিধায়ক বহিষ্কৃত হলে বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হত। জারি হত রাষ্ট্রপতি শাসন। সে ক্ষেত্রে ফের লম্বা আইনি লড়াইয়ের পরে নির্বাচন হতই। কিন্তু বর্তমান সরকারের হাতে এখনও তিন বছর সময় রয়েছে। অর্থাৎ এই তিন বছরে কেন্দ্রের বিস্তর টাকা রাজ্যে আসবে। অনেক সড়ক ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। এই অবস্থায় মন্ত্রিত্ব ও বিধায়কপদ চলে গেলে কারও লাভ নেই। তাই আপোসের রাস্তাই ছিল সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত।
এআইসিসির কাছেও অরুণাচল ধরে রাখা মর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুল শিবির যখন নেতৃত্ববদল চেয়েছিল, তখনই তা মেনে নিলে এই অস্থিরতাই হত না। তা না করে যে ভুল করেছিল হাইকম্যান্ড তা শুধরে নেয় গত রাতে।
কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে নিশি-আপাতনি-মিশমি-সহ বিভিন্ন উপজাতির প্রতিনিধিদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। গত কাল রাতে প্রস্তাব দেওয়া হয়, বিদ্রোহীদের আগের দাবি মেনে সরে যাবেন নিশি উপজাতির টুকি। টুকি শিবির দাবি করে, সম্মানের প্রশ্নে, টুকি যদি মুখ্যমন্ত্রী না থাকেন, তবে ইদু-মিশমি উপজাতির পুলকেও মুখ্যমন্ত্রী করা চলবে না। তখনই উঠে আসে মুক্তোর বিধায়ক পেমার নাম। তাঁর বাবা তিব্বতি উৎসের মন পা উপজাতির প্রতিনিধি দোর্জি খান্ডু সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন। ২০১১ সালে চপার দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পর থেকে পেমা বাবার আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন। টুকির আমলে তিনি ছিলেন পর্যটন ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী। বিদ্রোহ করে পুলের সঙ্গে এলেও তিনি মন্ত্রিত্ব পাননি। পুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল অম্লমধুর।
হিন্দু কলেজের স্নাতক, ৩৭ বছরের পেমা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে বলেন, "জটিলতা শেষ। পুরো কৃতিত্ব সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধীর। তাঁরাই আমাদের ফের এক ছাতার তলায় আনলেন। এখন সকলেই রাজ্যের উন্নতিতে সর্বসম্মতভাবে কাজ করব।" কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আগের বিদ্রোহকে নিছক 'মন কষাকষি' বলে ব্যাখ্যা করেন মুখ্যমন্ত্রী হতে চলা পেমা। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রেমা খান্ডু থুঙ্গনের পরে ফের এক যুব মুখ্যমন্ত্রী পাচ্ছে অরুণাচল।
পদত্যাগ করার পরে টুকি বলেন, "রাজ্যের ঐক্য, উন্নয়নের পরিবেশ বজায় রাখতেই পদত্যাগ করলাম। কংগ্রেসকে ঐক্যবদ্ধ করাই আমার লক্ষ্য ছিল। পুল ও আমার কোনও ঝগড়া নেই। সবাই একসঙ্গে কাজ করব। আজকের ঘটনা বিজেপির সব অপচেষ্টার পরাজয় ও কংগ্রেসের জয়।"
নাবাম রিবিয়াকে স্পিকার পদ থেকে অপসারণ করতেই বিধানসভা অধিবেশন এগিয়ে এনেছিলেন রাজ্যপাল জ্যোতিপ্রসাদ রাজখোয়া। তা থেকেই সাংবিধানিক সংকটের সূত্রপাত। রিবিয়ার করা মামলাতেই জিতে স্বপদে ফেরেন টুকি। ক্ষমতায় ফিরল কংগ্রেস। রিবিয়া এদিন রাজখোয়ার বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেন, "বিজেপি আর রাজখোয়া হাত মিলিয়ে সব ঝামেলা সৃষ্টি করেছিল। এমন রাজ্যপাল অন্যান্য রাজ্যে থাকলে ভারতের সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে।"
অরুণাচল দখলে গিয়ে হাত ও মুখ পোড়ানোর পরে গোটা ঘটনায় নিজেদের ভূমিকা অস্বীকার করে বিজেপি। এ দিন রাজ্যের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু বলেন, "অরুণাচলে যা হয়েছে- তা কংগ্রেসের নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব। আমরা শুধু পিপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন জানিয়েছি মাত্র।" রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার প্রসঙ্গে রিজিজু বলেন, "রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবণতি হওয়ায়, রাজ্যপালের পাঠানো রিপোর্টের ভিত্তিতেই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।"
আরও পড়ুন...
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে চান মুখ্যমন্ত্রী