ফাইল ছবি
‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পে আদৌ লাভ হবে, না কি উল্টে সেনায় বেনোজল ঢোকার রাস্তা খুলে গেল— তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত প্রাক্তন ও কর্মরত সেনাকর্তারা। কর্মরতদের একাংশের বক্তব্য, ‘অগ্নিপথ’ যোজনায় যে সব অগ্নিবীর যোগদান করবেন তাদের ২৫ শতাংশের সেনায় নিয়মিত ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকছে। যারা চার বছর সেনায় কাজের শেষে নতুন করে নিজের জীবন শুরু করতে পারবেন। ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় সরব অন্য শিবিরের বক্তব্য, এতে রাজকোষের অর্থ বাঁচলেও, ওই সিদ্ধান্ত ভারতীয় সেনাকে আদপে ‘রক্ষী সরবরাহকারী এজেন্সি’-তে পরিণত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বর্ষীয়ান সেনাকর্তা। তাঁদের মতে, ওই সিদ্ধান্ত আগামী দিনে সেনার ধর্মনিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক চরিত্রকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে।
গত কাল অগ্নিপথ প্রকল্পের ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। ওই যোজনায় ১৭-২১ বছরের তরুণ-তরুণীরা চার বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক সেনায় যোগ দিতে পারবেন। তাঁদের বলা হবে ‘অগ্নিবীর’। সেনায় শূন্য পদ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চতুর্থ বছরের শেষে সেই ব্যাচের সর্বাধিক ২৫ শতাংশ অগ্নিবীরকে সেনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সরকারে ওই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আজ বিহারের গয়া, পটনা মুজফফ্রপুর-সহ নানা জায়গায় চাকুরিপ্রার্থীরা রেললাইন অবরোধ করেন। তাঁদের মতে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের চাকরির বড় ভরসা হল ভারতীয় সেনা। চাকরিতে স্থায়িত্বের কারণে গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণেরা মূলত সেনার চাকরিকে বেছে নেন। দীর্ঘ প্রস্তুতির পরে সেনায় চাকরি পাওয়ার চার বছরের মধ্যেই যদি অবসর নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে কে তাদের নতুন করে চাকরি দেবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক-সহ একাধিক সংস্থা আজ বিবৃতি দিয়ে অগ্নিবীরদের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি করলেও, সেই দাবি বাস্তবে কতটা রাখা হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা। কেন্দ্রের আশঙ্কা, বিহারে শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভ আগামী দিনে দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ বলে সরব হয়েছেন একাধিক প্রাক্তন সেনাকর্তা। তাঁদের অধিকাংশের মতে, সরকারের ওই প্রকল্প রূপায়ণের আগে পাইলট প্রকল্প চালিয়ে প্রকল্পের ভালমন্দ দেখে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রাক্তন সেনাকর্তা মেজর জেনারেল বি এস ধানোয়া বলেন, “শুরুর আগে অন্তত চার-পাঁচ বছর ওই পাইলট প্রকল্প দেখে নেওয়া উচিত ছিল, বাস্তবের মাটিতে ওই জওয়ানদের নিয়ে কাজ করতে কমাণ্ডিং অফিসারদের কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে। তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে তবে ওই প্রকল্প চালু করা উচিত ছিল।” তাঁর পরামর্শ, “প্রকল্প যখন চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তখন অগ্নিবীরদের অবসর চারের পরিবর্তে সাত বছর করা হোক। আর প্রতি ব্যাচের অন্তত ৩০ শতাংশ অগ্নিবীরদের মূল সেনায় নিয়োগ করা হোক।” সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনায় সরব হয়েছেন মেজর জেনারেল জি ডি বক্সীও। তাঁর কথায়, “সেনায় এ ধরনের নিয়োগ চিনের মতো ভারতীয়ে সেনাবাহিনীতে এখন আংশিক সময়ের সেনায় ভরে যাবে। যা মোটেই কাম্য নয়।” কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার মতে, “বিজেপি সরকার সেনায় নিয়োগের বিষয়টি কেন নিজেদের প্রয়োগশালা হিসাবে দেখছে?” বিরোধীদের অভিযোগ, সেনাপিছু কোষাগারের খরচ বাঁচাতেই ওই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল যশ মোরের কথায়, “কোষাগারে কত অর্থ বাঁচল তা দিয়ে সেনার জীবনকে পরিমাপ না করা হয়।”
প্রশ্ন উঠেছে এত অল্প সময়ে এক জন সেনা কি আদৌ যুদ্ধে লড়ার প্রস্তুতি পেতে পারেন? প্রাক্তন সেনাকর্তাদের মতে, এক জন সেনাকে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে বিপক্ষের চোখে-চোখ রেখে গুলি ছুঁড়তে দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। ধানোয়ার মতে, “অগ্নিবীরেরা চার বছরের সময়ে ছুটি বাদ দিয়ে খুব বেশি হলে ২.৮ বছর কাজ করার সুযোগ পাবেন। যার মধ্যে প্রশিক্ষণ হবে ছয় মাস।” এত অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ ও কাজ করার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যদি তাদের পাকিস্তান বা চিন সীমান্তে মোতায়েন করা হয়, সে ক্ষেত্রে চাপের মুখে ওই সেনাদের স্নায়ু কাজ করবে তো? বিশেষ করে চার বছরের কাজের শেষে যেখানে তাদের জন্য অবসর নেওয়াই লেখা রয়েছে, সেখানে কেন তাঁরা জেনেবুঝে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক সমর বিশেষজ্ঞ। ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প ভারতের সেনার মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে। তাঁদের মতে, কাশ্মীরে দীর্ঘ সময়ে এক সঙ্গে কাজ করেও এখনও আধা সেনা ও সেনায় সমন্বয়ের অভাব ও মানসিকতার পার্থক্য রয়ে গিয়েছে। সেখানে চার বছরের জন্য কাজে করতে আসা একটি বাহিনীর সঙ্গে মূল সেনার মানসিক সমন্বয় আদৌ কী গড়ে ওঠা সম্ভব হবে?
অনেক সেনাকর্তার মতে, স্বাধীনতার পরের ৭৫ বছরে সেনা তাঁদের ধর্মনিরপক্ষে ও অরাজনৈতিক চরিত্র ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু গত কালের সিদ্ধান্তের পরে অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডি পি সিংহ মনে করছেন, “এ বার সেনাতেও ঘুণ ধরা শুরু হল। ধীরে ধীরে শেষ দূর্গও এ বার পতনের পথে।” অনেকের মতে, আগামী দিনে উপমহাদেশের অন্য দেশ পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সেনার মতো হাল হতে পারে ভারতীয় সেনার। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিনোদ ভাটিও সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে ভারতীয় সেনার কফিনে শেষ পেরেক বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথায়, “এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্যই পাইলট প্রকল্পের প্রয়োজন ছিল।” অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অজয় শেঠও মনে করেন, “আগে ছোট আকারে প্রয়োগ করে ভাল-মন্দ দেখে তা সেনার গোটা বাহিনীর উপরে প্রয়োগ করা উচিত ছিল।” তবে সরকারের সিদ্ধান্তের সমর্থনেও মুখ খুলেছেন একাধিক প্রাক্তন সেনা কর্তা। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক কুমারের মতে, এর ফলে ভারতীয় সেনায় গড় বয়স কমবে। আর এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তা ভাইস অ্যাডমিরাল এস সিন্হার কথায়, “সেনায় চাকরির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন অগ্নিবীরেরা।”
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।