কোঝিকোড়ের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী। রবিবার। ছবি: পিটিআই।
যুদ্ধের আঁচে জল ঢেলেছেন কাল। কিন্তু তাতে যে উরি নিয়ে দেশের মাটিতে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, সেটাও বুঝতে পারছেন হাড়ে হাড়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ তাই ঘোষণা করলেন, ‘‘যুদ্ধ বিকল্প নয়। কিন্তু জঙ্গি দমনে সামরিক অভিযান হবেই।’’
গত কাল তিনি সামনে এনেছিলেন, গরিবি হটানো নিয়ে দু’দেশের মধ্যে লড়াইয়ের তত্ত্ব। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের জনগণকে সে দেশের নেতাদের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তোলারও কৌশল নিয়েছিলেন। কিন্তু উরির ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর ‘মৌখিক’ হুঙ্কার এবং সেই কৌশল বিতর্কই বাড়িয়েছে শুধু। কারণ তাঁর বক্তব্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া জবাবের হদিসই ছিল অমিল। আজ তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে কৌশল কিছুটা পাল্টালেন মোদী। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে রোষ সামাল দিতে মাঝামাঝি পথ নিলেন। তাঁর বক্তব্য, যুদ্ধ না হলেও পাক জঙ্গি দমনে সামরিক অভিযান হচ্ছেই। এখন শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। সেনাবাহিনীকে খোলা ছুট দেওয়া আছে। তারাই ঠিক করবে, কখন কোথায় এই হামলা হবে।
বিজেপির পরিষদের বৈঠকে এই ঘোষণা করার আগে আজ আকাশবাণীর অনুষ্ঠানেও মোদী উরি প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘আমাদের সেনা বেশি কথা বলে না, বীরত্বেই জবাব দেয়।’’ বিরোধীরা কিন্তু মনে করছেন, মোদী আসলে সেনাবাহিনীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। কংগ্রেস আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছে মোদীর পাক-নীতি দিশাহীন। মোদীর এ দিনের ঘোষণার পরেও তারা একই অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে। কারণ, গত কালের মতো আজও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও রকম পদক্ষেপের কথা তিনি বলেননি। বলেছেন জঙ্গি দমনের কথা।
আকাশবাণীর অনুষ্ঠান থেকে দলের মঞ্চ— মোদী আজ নানা ভাবেই সরকারের এই নীতির পক্ষে সওয়াল চালিয়েছেন। এখানে দলের পরিষদের বৈঠকে একাধিক মন্ত্রী, সভাপতি অমিত শাহ-সহ বিভিন্ন নেতাকে দিয়েও বলিয়েছেন সে কথা। সকলেরই এক কথা, আগামিকাল রাষ্ট্রপুঞ্জে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কূটনৈতিক স্তরে পাকিস্তানকে একহাত তো নেবেনই। কিন্তু দেশে ভারতের সেনাও প্রস্তুত। নিয়ন্ত্রণরেখায় জঙ্গিদের হদিস পেলেই জবাব দেওয়া হবে বুলেটে।
মোদীর সুরে সুর মিলিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের সামনেই অমিত বলেন, ‘‘পাকিস্তান সরকারি নীতি হিসেবে সন্ত্রাসবাদ চালাচ্ছে, কোনও ভাবেই এটি যুদ্ধ অপরাধের থেকে কম নয়। নওয়াজ শরিফ সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করছেন। আমাদের সেনারা আট মাসে ১১৭ জন সন্ত্রাসবাদীকে মেরেছে। সেই হতাশাতেই উরিতে হামলা। কিন্তু এর জবাব সেনা দেবেই। লড়াই যতই দীর্ঘ হোক না কেন।’’ বিজেপির পরিষদের বৈঠকে সাধারণত এ ধরনের কোনও বিবৃতির পর দলের যে কেউ আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু মোদী-অমিতরা জানতেন, খোলা বৈঠকে এক বার এই সুযোগ দিলেই দলের ভিতরের অসন্তোষ প্রকাশ্যে চলে আসবে। সে কারণে বিবৃতির পরেই ঘোষণা করলেন, ‘‘এই নিয়ে আর আলোচনা করতে হবে না। হাত তুলেই এর অনুমোদন করে দেওয়া হোক।’’
আলোচনা হলে অবধারিত ভাবে যে প্রশ্নটি উঠে আসত, তা হল, কড়া জবাব কবে, কী ভাবে, কোন পথে দেওয়া হবে? আসলে পাঠানকোটের পর উরির ঘটনা ঘটে যাওয়ায় এখন নিজের সঙ্গেই নিরন্তর লড়তে হচ্ছে মোদীকে। বিরোধী নেতা হিসেবে যে মোদী এক সময় কথায় কথায় পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেওয়ার কথা বলতেন, প্রশ্ন উঠছে আজ তিনি শুধুমাত্র কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েই ক্ষান্ত কেন? মুখে হুঙ্কার দিয়েও বাস্তব পদক্ষেপে কেন পিছপা?
পরিষদের বৈঠকের শেষ দিনে সেই প্রশ্নের নিরসন করতেই যেন সামনে আনা হল একঝাঁক নেতা-মন্ত্রীকে। তাঁরা বোঝালেন, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ পায়। এর পর নিয়ন্ত্রণরেখার ১-২ কিলোমিটার দূরে ওত পেতে থাকে ভারতে ঢোকার জন্য। যেটিকে বলা হয় ‘লঞ্চিং প্যাড’। সেনা এ বার টের পেলেই মোক্ষম জবাব দেবে তাদের। মিলিটারি অপারেশনের ডিরেক্টর জেনারেল রণবীর সিংহ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, সেনা কখন কোথায় কী ভাবে জবাব দেবে, সেটি তারাই ঠিক করবে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই সেনাকে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে রেখেছেন। যে পাকিস্তান-বিরোধী মুখ রাম মাধব ‘দাঁতের বদলে চোয়াল’ খুলে নেওয়ার কথা বলেছিলেন, তিনিই আজ বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জে সুষমা স্বরাজের বক্তব্য পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সেনা জবাব দেবেই।’’
বিজেপির এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘আসলে সেনা কখন কোথায় কী ভাবে জবাব দেবে, সেটি তো আগে ঢাকঢোল পিয়ে বলার নয়। কিন্তু ক্ষুব্ধ দেশবাসী সেটিই শুনতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে। সেই উত্তর না পাওয়াতেই ক্ষোভ জমছে। তাই প্রধানমন্ত্রী বারবার সেনার উপরে ভরসা রাখতে বলছেন।’’ একই সঙ্গে দলের ভিতর-বাইরে এই রোষে কী ভাবে রাশ টানা যায়, সেটিও ভাবতে হচ্ছে মোদীকে। তাই আজ তিনি মন কি বাত অনুষ্ঠানে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। মনে করিয়ে দেন, তখনও দেশের ভিতরে এমন একটি আক্রোশের পরিস্থিতি ছিল। দেশভক্তির কারণে অনেকেরই দেশের জন্য কিছু না কিছু করার প্রচণ্ড তাগিদ ছিল। লালবাহাদুর শাস্ত্রী সেই সময় ‘জয় জওয়ান, জয় কিষাণ’ মন্ত্র দিয়ে আক্রোশকে গঠনমূলক কাজে চালিত করেন। গাঁধীজিও আন্দোলনের সময় উদ্দীপনাকে এ ভাবে গঠনমূলক কাজে চালিত করতেন।
মোদী বলেন, ‘‘বোমা-বন্দুকের আওয়াজের মধ্যেও দেশভক্তি জাহির করার অন্য পন্থা আছে।’’ এই সুযোগে কাশ্মীরের জনতার আস্থা অর্জনেরও চেষ্টা করেন প্রধানমন্ত্রী। বোঝানোর চেষ্টা করেন, পাকিস্তানই তাঁদের একাংশকে বিভ্রান্ত করেছিল। মানুষ তা বুঝতে পেরেছেন বলেই উপত্যকায় শান্তি ফিরছে। এখন মূলস্রোতে ফিরতে হবে। আর নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের।