জেএনইউ-এর উপাচার্য শান্তিশ্রী ধুলীপুড়ী পণ্ডিত।
নৃতত্ত্ববিদ্যার যুক্তিতে বিচার করলে হিন্দুদের কোনও দেবতাই উঁচু জাতের নন। কোনও দেবতাই ব্রাহ্মণ নন। আর মনুস্মৃতি সব মহিলাকেই শূদ্র বলে মনে করে। গত কাল এক বক্তৃতায় এই মন্তব্য করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এর উপাচার্য শান্তিশ্রী ধুলীপুড়ী পণ্ডিত। উল্লেখ্য, তিনিই জেএনইউয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য।
কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক আয়োজিত এক বক্তৃতামালায় গত কাল শান্তিশ্রী বলেছেন লিঙ্গনির্বিশেষে সুবিচার প্রসঙ্গে বি আর অম্বেডকরের ভাবনা এবং অভিন্ন দেওয়ানি নীতি নিয়ে। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেবতাদের জন্মের দিকে তাকালে দেখবেন, কোনও দেবতাই ব্রাহ্মণ নন। খুব বেশি হলে ক্ষত্রিয়। শিব সম্ভবত তফসিলি জাতি বা জনজাতির প্রতিনিধি, কারণ তিনি সাপ নিয়ে শ্মশানে বাস করেন। কেউ তাঁকে বস্ত্রটুকুও দেয়নি। আমার মনে হয় না, কোনও ব্রাহ্মণ এ ভাবে শ্মশানে থাকতে পারেন। নৃতত্ত্বের যুক্তিতে এতেই স্পষ্ট যে, লক্ষ্মী, শক্তি-সহ আমাদের দেবতারা কেউই উচ্চ শ্রেণি থেকে আসেননি। জগন্নাথ একান্ত ভাবেই জনজাতির প্রতিনিধি। কাজেই আমরা এই অমানবিক বৈষম্যটাকে টেনে যাচ্ছি কেন?’’
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি রাজস্থানে শিক্ষকের মার খেয়ে মারা যাওয়া দলিত বালকের কথা তুলেছেন উপাচার্য। বলেছেন, ‘‘আজ জন্মগত ভাবেই মানুষের জাত ঠিক হয়ে যায়। কোনও ব্রাহ্মণ বা অন্য জাতির মানুষ মুচির কাজ করলেই কি দলিত হয়ে যান? হন না। এ কথা বলছি, কারণ রাজস্থানে সম্প্রতি উচ্চবর্ণের জন্য রাখা জল ছুঁয়ে ফেলায় এক দলিত ছেলেকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। প্রশ্নটা মানবাধিকারের। কোনও সহনাগরিকের সঙ্গে কি এই আচরণ করা যায়?’’ জাতিভেদ বিলোপ নিয়ে অম্বেডকরের বিখ্যাত বক্তৃতার উল্লেখ করে শান্তিশ্রী বলেন, ‘‘ভারতীয় সমাজের মঙ্গল করতে হলে জাতিভেদের বিলোপ অবশ্যই জরুরি। এমন ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী পরিচয় নিয়ে এত আবেগ কিসের? এই কৃত্রিম পরিচয়কে রক্ষা করতে গিয়ে আমরা মানুষ খুনও করতে পারি।’’
বহু সময়েই জাতের সঙ্গে জড়িয়ে যায় লিঙ্গ-পরিচয়। শান্তিশ্রীর মতে, কোনও মহিলা যদি সংরক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি হন, তা হলে তিনি দু’দিক থেকেই প্রান্তিক মানুষ হয়ে যান— প্রথমত তিনি মহিলা বলে, দ্বিতীয়ত, তাঁর জাতিগত পরিচয়ের জন্য। মনুস্মৃতি সব মহিলাকেই শূদ্র বলে দাগিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘‘কোনও মহিলাই দাবি করতে পারেন না, তিনি ব্রাহ্মণ বা অন্য কোনও জাতির। হয় তিনি তাঁর বাবার জাত পাবেন, নয়তো স্বামীর। অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী একটা ভাবনা। সব অধিকার পুরুষেরাই ছিনিয়ে রেখেছেন। এ দিকে, মহিলারা তাঁদের অধিকার চাইলেই ধর্ম-ঈশ্বর সব ঠুনকো হয়ে যায়। সবাই দল পাকাতে থাকে।’’ শান্তিশ্রী আরও বলেন, ‘‘সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছিলেন, মহিলাদের জন্ম হয় না, সৃষ্টি হয়। অম্বেডকরের ভাবনাও একই।’’
মনুবাদী ভাবনা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের রাজনীতি করার অভিযোগে বিজেপিকে নিয়মিত কাঠগড়ায় তোলে বিরোধীরা। জেএনইউয়ের উপাচার্যের বক্তব্য গেরুয়া শিবিরের কাছে কিছুটা হলেও অস্বস্তিকর। তবে বিজেপির আর এক লক্ষ্য, অভিন্ন দেওয়ানি নীতিকে সমর্থন করেছেন শান্তিশ্রী। তাঁর মতে, অম্বেডকরের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে অভিন্ন দেওয়ানি নীতি কোনও হিন্দু বিল নয়। বর্তমানে নানা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত আইন সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় লিপির ভিত্তিতে স্থির হয়। তার বদলে ভারতে অভিন্ন ফৌজদারি আইনের মতো ধর্ম, লিঙ্গ, যৌন পছন্দ নির্বিশেষে অভিন্ন দেওয়ানি আইনও থাকা উচিত। এর বিরোধিতা করা ঠিক নয়।