ইস্তফা দেওয়ার আগে মুম্বই হামলায় নিহতদের শ্রদ্ধা দেবেন্দ্র ফডণবীসের। সংসদে সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠানে অমিত শাহ। এএফপি ও পিটিআই
এ যাবৎ লড়াই ছিল খালি ময়দানে। গোয়া থেকে মণিপুর, কর্নাটক থেকে হরিয়ানা— সর্বত্র তুড়ি মেরে সরকার গড়েছেন অমিত শাহ। কিন্তু সেয়ানে-সেয়ানে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতেই হল বিজেপির ‘চাণক্য’ অমিত শাহকে। বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখিয়ে শেষ বাজি জিতে নিলেন ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’ শরদ পওয়ার। যিনি গতকালই দলীয় বৈঠকে বলেছিলেন, ‘‘মহারাষ্ট্র কিন্তু গোয়া বা মণিপুর নয়। মহারাষ্ট্রে কে সরকার গড়ে, আমি না অমিত শাহ— তার শেষ দেখে ছাড়ব।’’ তিনি যে ফাঁকা বুলি আওড়াননি, তা আজ পরিষ্কার হয়ে গেল অমিত শাহরা পিছু হটায়।
গত শনিবার যখন বিজেপি ভোরের আলো ভাল করে ফোটার আগেই সরকার গড়ে ফেলেছিল, তখন অমিত শাহকে ভারতীয় রাজনীতির আধুনিক চাণক্য হিসেবে তুলে ধরে হইহই করে প্রচারে নেমে পড়ে গোটা বিজেপি শিবির। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, ‘‘অমিত শাহই হলেন ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’।’’ কিন্তু খেলা যে তখনও শেষ হয়নি, তা আজ বিজেপির সরকার ফেলে দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন শরদ পওয়ার। চলতি নির্বাচনের ফলাফল আসার পর থেকেই শিবসেনা থেকে এনসিপি — সকলেরই আক্রমণের একমাত্র নিশানা ছিলেন অমিত শাহ। আজ দেবেন্দ্রর ইস্তফার পরে সেই কাজে অনেকাংশেই সফল বিরোধীরা। কংগ্রেসও তাই বলছে, ‘‘অমিত শাহকে এ বার অন্তত চাণক্য বলা বন্ধ হোক। তিনি সরকার গড়তে গিয়ে রাজ্যগুলিতে যা করেছেন, তা চাণক্য নীতির অপমান। গণতন্ত্রের অপমান।’’
রাজনীতির অনেকেই বলছেন, এ বারের সরকার গড়াকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন শরদ পওয়ার। বিশেষ করে অজিত পওয়ার উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে এনসিপিতে আড়াআড়ি ভাবে ভাঙনের আশঙ্কা ছিল। রাজনৈতিক ভাবেও অমিত শাহরা এ বার মহারাষ্ট্রে এনসিপি-কে ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বলে আশঙ্কা ছিল শরদ শিবিরে। তাই দল বাঁচাতে মরিয়া ভাবে ময়দানে নামেন শরদ। দলে যে অজিতের সমর্থনে বেশ কিছু বিধায়ক রয়েছেন এবং তাঁরা যে অন্য বিধায়কদের ভাঙাতে পারেন, সেই তথ্য ছিল শরদের কাছে। তা ছাড়া শপথের দিন অজিতের সঙ্গী বিধায়কেরা পরে শরদ শিবিরে ফিরে এলেও তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ ছিল বর্ষীয়ান নেতার। তাই নিজের অনুগামীদের একটি হোটেলে এবং যাঁরা অজিত শিবিরের প্রতি নরম, তাঁদের অন্য হোটেলে রাখেন। যাতে কোনও ভাবেই অজিতের লোকেরা শরদ শিবির ভাঙতে না পারেন। এনসিপির এক নেতার কথায়, ‘‘টাকার লোভ দেখিয়ে বিধায়ক কেনার বিজেপির যে কৌশল, তা আটকে দেন শরদ। সেটাই তাঁর সাফল্যের কারণ। এনসিপি শিবিরে সিঁদ কাটতে ব্যর্থ হন অমিত শাহ। সেখানেই পওয়ারের কাছে হার শাহের।’’ এনসিপি নেতা নবাব মালিকের কথায়, ‘‘কে আসল চাণক্য, তা বুঝিয়ে দিলেন শরদ।’’
শনিবার দেবেন্দ্র ফডণবীশ শপথ নেওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে টুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন অমিত শাহ। আজ তিনি নিশ্চুপ। বিজেপির কাছে এখন সবচেয়ে অস্বস্তির ব্যাপার, গোটা প্রক্রিয়াটিতে অমিত শাহের সঙ্গেই মুখ পুড়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও। শুরু থেকেই শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত দাবি করে আসছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের কোনও ক্ষোভ নেই। কারণ তিনি জানেন না, মাতুশ্রীতে এসে অমিত শাহ মহারাষ্ট্রে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ সমীকরণ মেনে চলার আশ্বাস দিয়েছিলেন উদ্ধব ঠাকরেকে। বিরোধীরা বলছেন, অমিত শাহ ভেবেছিলেন শিবসেনাকে বুঝিয়ে পাশে পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ফলে প্রথম ধাক্কা খান অমিত শাহ।
এখানেই শেষ নয়। গত শনিবার সকালে বিশেষ আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে কেবল মাত্র প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসন তোলার সুপারিশ করা হয়। স্বভাবতই বিজেপির মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী যখন ওই পদক্ষেপ করছেন, তার মানে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, ওই রাজ্যে বিজেপির কাছে প্রয়োজনীয় সংখ্যা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে সেই ভরসা কে দিল? আঙুল উঠেছে অমিত শাহের দিকেই। কিন্তু এখন এর দায় কে নেবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে দলের মধ্যে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বাঁচাতে আজ দেবেন্দ্র ফডণবীস জানিয়েছেন, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব নিশ্চিত ছিল প্রয়োজনীয় বিধায়ক সঙ্গে রয়েছে। সেই তথ্যই দিল্লিকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু যে ব্যক্তিকে পাশে নিয়ে আজ ফডণবীস সাংবাদিক সম্মেলন করেন, পরে রাজ্যপালের কাছে ইস্তফা দেওয়ার সময়ে যাঁকে দেবেন্দ্রর পাশে দেখা যায়, সেই ভূপেন্দ্র যাদব বিজেপিতে অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। যিনি অমিত শাহের নির্দেশে সরকার গড়তে গত শুক্রবার রাতে মুম্বই উড়ে গিয়েছিলেন।
আপাতত সেই ভূপেন্দ্রের মাধ্যমে প্রবল ভাবে ক্ষত মেরামতিতে নেমেছে অমিত শাহ শিবির। দলের একটি অংশ বলছে, কোনও নিয়ম ভাঙা হয়নি। যদি হত, তা হলে সুপ্রিম কোর্ট তা নিয়ে প্রশ্ন তুলত। তা তারা করেনি। আদালত ভোটাভুটির কথা বলেছে। তাই হচ্ছে। কংগ্রেস শিবিরের এক নেতা পাল্টা বলেন, ‘‘বিজেপি বুঝতে পারছে, অমিত শাহর ভাবমূর্তি রক্ষা সবচেয়ে দরকারি। তা না হলে বদনাম হবে খোদ প্রধানমন্ত্রীর। যা আরও অস্বস্তির।’’