অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খুলে এ বারে নিজেই অসহিষ্ণুতার মুখে পড়লেন বলিউডের মিস্টার পারফেকশনিস্ট।
গতকাল রাতে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে আমির খান বলেছিলেন, দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। এতটাই যে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। এই মন্তব্যের পর থেকেই কাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। আমিরকে দেশ ছাড়ার শাসানিও দেওয়া হয়। আজ তাঁর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে চলে যায় হিন্দু সেনার দল। দিল্লিতে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগও দায়ের হয়। যোগী আদিত্যনাথ, সাক্ষী মহারাজের মত কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতারাও ফের শীতঘুম কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়িয়েছেন।
আমিরের এক মন্তব্যে স্পষ্ট, অল ইজ ‘নট’ ওয়েল।
শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, গত ক’দিনে ঝিমিয়ে পড়া অসহিষ্ণুতা বিতর্ক সংসদের মুখে ফের মাথাচাড়া দিতে ঝড় অচিরেই আছড়ে পড়েছে রাজনীতির অলিন্দেও। এর আগে বিজেপি শিল্পীকুল থেকে সমর্থক জোটাতে হিমশিম খাচ্ছিল। এখন অনুপম খেরদের নেতৃত্বে একটি মাঝারি গোছের ব্রিগেডও খাড়া করতে পেরেছে। তাঁরাও এখন সক্রিয় হয়ে বলিউডেও বিভাজনের ছবিটা তুলে ধরতে পেরেছেন।
আমিরের মন্তব্যকে ঘিরে রোষ দেখে সকাল থেকেই গেরুয়া শিবির ঝাঁঝিয়ে উঠেছে। আর তা দেখে সুযোগ বুঝে আসরে নেমে পড়েছেন স্বয়ং রাহুল গাঁধী। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সংসদের অধিবেশনের ঠিক মুখে আমিরের মন্তব্য অসহিষ্ণুতা বিতর্ককে আরও তাজা করে তোলায় শাসক দলকে একহাত নিতে নামেন তিনি। কংগ্রেস সহ সভাপতি অবশ্য আমিরের নাম মুখে আনেননি। কিন্তু বলেন, ‘‘কেউ সরকার ও মোদীজির সমালোচনা করলেই তাঁর গায়ে দেশদ্রোহীর তকমা সেঁটে দেওয়া ঠিক নয়। কী কারণে তাঁরা অস্থির হয়ে উঠছেন, তা বুঝতে সরকারের উচিত তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। ধমকে, ভয় দেখিয়ে, গালমন্দ করে সমস্যার সমাধান হবে না।’’
অতীতে দাদরির ঘটনায় অনেক দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেওয়ায় হাত পোড়াতে হয়েছে বিজেপি ও মোদী সরকারকে। সেই সময় বিজেপি নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায় যখন উত্তরপ্রদেশ সরকারের, তখন কেন আগ বাড়িয়ে বিজেপি প্রতিক্রিয়া দিতে যাবে! যোগী আদিত্যনাথ, সাক্ষী মহারাজদের উপরেও তেমন রাশ টানা হয়নি। কিন্তু যখন বিজেপির কট্টর নেতারা আজ সরব হতে শুরু করেন, তখন বিজেপিও বোঝে তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া না দিলে আবার ‘ভুল’ হবে। ‘ইটের বদলে পাটকেল’-এর রাজনীতির আঁচ বুমেরাং হয়ে বিজেপির উপরেই পড়বে। তাই সক্কাল সক্কাল যখন রাহুল গাঁধী আসরে নেমে পড়েছেন, তখন রাজনৈতিকভাবে তার মোকাবিলা করতে বিজেপি সামনে নিয়ে আসে শাহনওয়াজ হোসেন, মোখতার আব্বাস নকভির মতো সংখ্যালঘু নেতাদের।
শাহনওয়াজ হোসেন বলেন, ‘‘আমির খান ভয় পাচ্ছেন না। ভয় পাওয়াচ্ছেন। আর রাহুল গাঁধী যখন সমর্থন করলেন, তখনই স্পষ্ট এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা।’’ মোদী সরকারের মন্ত্রী হিসেবে অবশ্য নকভি কিছুটা সংযত থেকে বলেন, ‘‘আমরা আমিরকে দেশ ছাড়তে দেব না। তিনি এ দেশে নিরাপদ। কিন্তু আমিরকে যাঁরা সম্মান দিয়েছেন, এ ধরণের রাজনৈতিক মন্তব্য তাঁদের অপমান।’’ একই ভাষা আর এক মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির। তিনি বলেন, ‘‘আমির খোলাখুলি মত প্রকাশ করতে পারছেন, সেটিই তো সহিষ্ণুতার পরিচয়। সকলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দরজা খোলা। ক’দিন আগেই একদল শিল্পী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদেরও প্রধানমন্ত্রী একই কথা বলেছেন।’’
ক’দিন আগে অনুপম খেরের নেতৃত্বেই একদল শিল্পী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। যাঁরা অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রতিবাদে পাল্টা আন্দোলনে সামিল হয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রা করেন। বিজেপির উদ্যোগে তৈরি শিল্পীদের এই গোষ্ঠীই আজ আমিরের বিরুদ্ধে সরব হন। অনুপম খের আমিরের কাছে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আপনার স্ত্রী কিরণ রাওকে কী আপনি বলেছেন, অতীতে এর থেকে খারাপ সময়েও এ দেশে কাটিয়েছেন, কিন্তু তখনও দেশ ছাড়ার কথা ভাবেননি? কিরণ কোন দেশে যেতে চান? স্ত্রীকে কি বলেছেন, এই দেশই আপনাকে আমির খান বানিয়েছে?’’ বিজেপি সাংসদ ও অভিনেতা পরেশ রাওয়ালও বলেন, ‘‘খারাপ সময় প্রকৃত যোদ্ধা কখনও মাতৃভূমি ছেড়ে পালান না।’’ এযাবৎ ভারত সরকারের পর্যটন বিভাগের ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে কাজ করেছেন আমির। অনুপম সেটি খুঁচিয়ে বলেন, ‘‘মাত্র ৭-৮ মাসের মধ্যে কী করে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া কী করে ইনটলারেন্ট ইন্ডিয়া হয়ে গেল?’’ আমিরের বিপক্ষে মত রেখে সরব হয়েছেন ঋষি কপুর, রবিনা টন্ডনের মত শিল্পীরাও।
ক’দিন আগে বলিউডের তিন খানের অন্য দুই খান- শাহরুখ ও সলমনও একইভাবে মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু শাহরুখকে অতীতে কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে দেখা গিয়েছে। সে ভাবে কোনও দিনই বিজেপির সঙ্গে সখ্যতা ছিল না তাঁর। কিন্তু আমির সে ভাবে কোনও দিনই বিজেপি বিরোধী ছিলেন না। লালকৃষ্ণ আডবাণী, তাঁর কন্যা প্রতিভার পাশে বসে সিনেমা দেখতে দেখা গিয়েছে। মোদী সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী নাজমা হেফতুল্লার আত্মীয় তিনি। কিন্তু তারপরেই প্রশ্ন উঠছে, গতকাল অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডুর মত সরকারের শীর্ষ নেতারা যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সেখানে এমন একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করতে গেলেন কেন তিনি? তাহলে কি বিজেপির মধ্যেই মোদী ও অমিত শাহ জুটির বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ রয়েছে, তাঁদেরই মনের কথা তুলে ধরলেন আমির?
শাহরুখ খানের সময় বিতর্কিত মন্তব্য করে ঢোক গিলতে হয়েছিল অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। আজ তিনি অবশ্য সংযম দেখিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের কথা প্রকাশ্যে আনেন। আমির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা বিদেশে কালো টাকা গচ্ছিত রেখেছেন, তাঁরাই অসহিষ্ণুতার কথা বলেন।’’ তবে বিজেপির কাছে কিছুটা স্বস্তি এনেছে এআইএমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়েসি। তিনি আমিরের মন্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘এ ধরণরে কান্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যে আমরা পা দেবনা। আমাদের দেশকে উন্নত করার জন্যই আমরা লড়াই করে যাব।’’ যদিও বিরোধীরা বলে, বিহারের নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাত করেই লড়েছেন ওয়েসি। কিন্তু এই ইস্যু যাতে সংসদের অধিবেশন পর্যন্ত জিইয়ে রাখা যায়, তারজন্য উঠেপড়ে লেগেছে কংগ্রেস। রাহুল মুখ খুলতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন কংগ্রেসের সর্বস্তরের নেতারা। কাল বেঙ্গালুরুতে মাউন্ট কার্মেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছেন রাহুল। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, সেখানেও অসহিষ্ণুতা বিতর্ককে হাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করবেন রাহুল।
আনন্দ শর্মা বলেন, ‘‘রাজনৈতিক আঙিনায় নেই এমন অনেকেই দেশের চলতি পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আজকের ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভয় দেখিয়ে অসন্তোষের কন্ঠরোধ করতে চাইছে শাসক দল।’’ সমাজকর্মী শবনম হাসমিও বলেন, ‘‘আমির যা বলেছেন, তা যথার্থ। আজ যে রকম মন্তব্য চারদিক থেকে আসছে, তাতে সংখ্যালঘুরা কোথায় নিরাপদ অনুভব করছেন?’’ তবে মোদী-ঘনিষ্ঠ সংখ্যালঘু মুখ জাফর সরেশওয়ালা বলেন, ‘‘চল্লিশের দশকে ও স্বাধীনতার দশ বছর পর, এমনকী বাবরি, গুজরাত দাঙ্গার পরেও যে ভয়ের পরিবেশ ছিল, এখন তা নেই। সাক্ষী মহারাজ, যোগী আদিত্যনাথদের বিক্ষিপ্ত মন্তব্য তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু অসম, ত্রিপুরার রাজ্যপালরা যখন বিতর্কিত মন্তব্য করেন, সেই সময় কেন রাশ টানা হয় না? তবে আমির যা বলছেন, আজকের বাস্তব পরিস্থিতি তা নয়। এখন আর সেই ভয়ের পরিবেশ নেই।’’