প্রতীকী ছবি।
পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোদস্তুর যুদ্ধে এখনই জড়াতে চায় না ভারত। যুদ্ধ ঘোষণা সব সময়েই অন্তিম বিকল্প। তাই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে ঢুকে বিধ্বংসী অভিযান চালানোর পর সেনাবাহিনীর মনোবল যখন তুঙ্গে, তখনও যুদ্ধের হুঙ্কার ছাড়ছে না ভারত। বরং জঙ্গিদের সমুচিত জবাব দেওয়ার পর নয়াদিল্লি অন্য পথে কোণঠাসা করতে চাইছে পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক ভাবে ইসলামাবাদকে আরও চাপে ফেলে দিতে চাইছে নয়াদিল্লি। কিন্তু কেন? পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও সামরিক পদক্ষেপ কী নেওয়া যায় না? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ ছাড়াও আরও এক গুচ্ছ সামরিক পথ রয়েছে। কিন্তু তার বিপদও রয়েছে।
পাকিস্তানকে জব্দ করার অন্যান্য সামরিক পথগুলি কী কী? সে সব পথের বিপদই বা কী কী?
১. রাতের আড়াল নিয়ে আবার আঘাত করতে পারে ভারত। বার বার এই রকম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক জঙ্গি পরিকাঠামো নিঃশেষ করে দিতে পারে। এই ধরনের অভিযান চালানোর সক্ষমতা ভারতীয় সেনার যথেষ্ট রয়েছে। শুধু এই কাজের জন্যই প্রশিক্ষিত বাহিনী রয়েছে। সেই বাহিনী যে যথেষ্ট সফল ভাবে অভিযান চালাতে পারে, তাও স্পষ্ট।
কিন্তু:
প্রথমত, বার বার এমন আঘাত হতে থাকলে জঙ্গিরাও সতর্ক হয়ে যাবে। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে রাতের অন্ধকারে যত দূর ঢুকে হামলা চালানো সম্ভব, সেই এলাকার মধ্যে আর কোনও ঘাঁটি তৈরি করবে না জঙ্গিরা।
দ্বিতীয়ত, অনেক জঙ্গি ঘাঁটিই স্কুল বা মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানে তৈরি করা হয়। সেখানে অভিযান চালালে সাধারণ নাগরিকদের জীবনহানির শঙ্কা থাকে।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানের সেনা ভারতীয় কম্যান্ডোদের মোকাবিলায় নেমে পড়তে পারে। তাতে দু’পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। দু’পক্ষই যদি সাবধানী পদক্ষেপ নেয়, তা হলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। তবে তাতে কারও লক্ষ্যই সাধিত হবে না শেষ পর্যন্ত।
২. নিয়ন্ত্রণ রেখা এ পার থেকেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের দিকে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করতে পারে ভারত। এই ধরনের গোলাবর্ষণ মাঝেমধ্যেই হয়েও থাকে সেখানে।
কিন্তু:
প্রথমত, এই ধরনের হামলায় কোনও গোপনীয়তা নেই। ফলে হামলা শুরু হতেই পাকিস্তানের দিক থেকেই একই ভাবে গোলাবর্ষণ হবে।
দ্বিতীয়ত, এর জেরে অনুপ্রবেশ বাড়বে। সীমান্তে যখন দু’পক্ষের মধ্যে ভারী গোলাগুলি চলে, তখন সীমান্ত থেকে বাহিনীকে কিছুটা পিছিয়ে নিরাপদ অবস্থান নিতে হয়। সেই সুযোগ নিয়ে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে। পাক বাহিনী দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতে এই ভাবে জঙ্গি ঢোকায়। লঞ্চিং প্যাড থেকে জঙ্গিরা যখনই যাত্রা শুরু করে নিয়ন্ত্রণ রেখার দিকে, তখনই পিছন থেকে তাদের কভার ফায়ার দিতে শুরু করে পাক সেনা। ভারতীয় বাহিনীকে পিছিয়ে আসতে হয় এবং পাল্টা গোলাবর্ষণ করতে হয়। সেই সুযোগে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরোয় জঙ্গিরা।
তৃতীয়ত, দু’পক্ষে নিরন্তর গোলাবর্ষণ হতে থাকলে জম্মুতে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে বাসিন্দারা থাকতে পারবেন না। তাঁদের এলাকা ছেড়ে আশ্রয় শিবিরে চলে যেতে হবে।
৩. বিমানহানা চালাতে পারে ভারত। ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে মিরাজ-২০০০, জাগুয়ার এবং সুখোই-৩০এমকেআই-এর মতো উচ্চ দক্ষতার যুদ্ধবিমান রয়েছে। অনেকটা দূর থেকেই জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ আঘাত হানতে সক্ষম এই সব যুদ্ধবিমান।
কিন্তু:
প্রথমত, এ ক্ষেত্রেও জঙ্গিরা শিবির খালি করে দিয়ে পাকিস্তানের ভিতরের দিকে চলে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, খুব সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই এই বিমানহানা চালাতে হবে। গোয়েন্দা তথ্যে সামান্য ত্রুটি থাকলেই বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকবে।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে ভারত হামলা চালালে, পাকিস্তানও পাল্টা আঘাত হানবে। তাতে ভারতীয় বায়ুসেনার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সে রকম হলে পরিস্থিতি পুরোদস্তুর যুদ্ধের দিকেই গড়াবে।
৪. পাকিস্তানে যে জঙ্গি সংগঠনের নেতারা খোলাখুলি নিজেদের কার্যকলাপ চালাচ্ছে, ভারত নিজেদের গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করতে পারে।
কিন্তু:
প্রথমত, পাকিস্তানে ভারতের গোপন নেটওয়ার্ক বা গুপ্তচরের সংখ্যা এখন আগের চেয়ে অনেক কম। ফলে হামলা চালানো কঠিন।
দ্বিতীয়ত, লস্কর-ই-তৈবা, জইশ-ই-মহম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিনের কম্যান্ডররা পাকিস্তানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে থাকে। পাক সেনা এবং গুপ্তচর সংস্থা তাদের নিরাপত্তা দেয়। ফলে ভারতীয় গুপ্তচরদের পক্ষে তাদের কাছাকাছি পৌঁছনো কঠিন।
তৃতীয়ত, যদি কয়েক জন জঙ্গি নেতাকে হত্যা করাও হয়, তাতেও জঙ্গি পরিকাঠামো নির্মূল হওয়ার কোনও আশা নেই।
৫. দেশের এক প্রাক্তন সেনাপ্রধান সম্প্রতি ভারতের নিজস্ব ফিদায়েঁ বাহিনী গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। পাকিস্তান যে ভাবে আত্মঘাতী বাহিনী পাঠিয়ে বার বার ভারতকে রক্তাক্ত করে, ঠিক সেই ভাবে ভারতও পাকিস্তানে আত্মঘাতী বাহিনী পাঠাক। এমনই মত ওই প্রাক্তন সেনাপ্রধানের।
কিন্তু:
এই ফিদায়েঁ বা আত্মঘাতী বাহিনী গড়ে তোলা ভারতীয় সেনার পক্ষে কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। জেনেশুনে কে আত্মঘাতী বাহিনীতে চাকরি করতে আসবেন? পাকিস্তানে যেমন একাধিক ভারত বিরোধী জঙ্গি সংগঠন রয়েছে, ভারতে তো আর তেমন পাকিস্তান বিরোধী জঙ্গি সংগঠন নেই। ফলে বিদ্বেষের আফিম খাইয়ে মানুষকে আত্মঘাতী জঙ্গি হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করার লোকও নেই। সে ক্ষেত্রে আত্মঘাতী বাহিনী সেনাকেই তৈরি করতে হবে। কিন্তু সেনার পক্ষে কোনও আত্মঘাতী পদে কাউকে নিয়োগ করা অসম্ভব।
অতএব, যুদ্ধ ছাড়া আর যে সব সামরিক পদক্ষেপ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া যেতে পারে বলে আলোচনা চলছে, সে সব পদক্ষেপে যে যথেষ্ট বিপদ রয়েছে, তা স্পষ্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরাই সে কথা বলছেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এইচ জ্যাকবও সম্প্রতি এক নিবন্ধে এই রকম মতই প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক ভাবে আরও চাপে ফেলে দেওয়াই এখন সবচেয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ হবে। নয়াদিল্লির সে পথেই এগনো উচিত।