গোশালাতেই বোঝা যায় সামনে ভোট

শামিম লক্ষ করছেন, গত ক’বছর যখনই ছোট-বড় ভোট আসছে, তখনই পরিবেশটা পাল্টে যাচ্ছে। হাওয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনা। পরিবহণের খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হুটহাট। ফলে গরু-মোষ নিয়ে রাতের অন্ধকারে চলাফেরা বাড়ছে আর সেই সুযোগে নেমে আসছে আক্রমণ! মারধর, লুঠতরাজ আর শাসানি শুরু হয়ে যাচ্ছে!

Advertisement

অগ্নি রায়

অলওয়ার শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৮ ০৩:৫০
Share:

স্বজনহারা: শোকে মুহ্যমান নিহত আকবরের স্ত্রী আসমিনা।  —নিজস্ব চিত্র।

উঁচু গলায় প্রতিবাদ করতে ভয়। রাতে মহল্লার বাইরে যেতে ভয়। আশপাশের গ্রাম থেকে গরু তো দূরস্থান, অন্য কোনও পণ্য টেম্পোতে চড়িয়ে আনতেও ভয়।

Advertisement

‘শোলে’র সংলাপ একটু পাল্টে নেওয়া যাক। গ্রামে শিশুরা দুষ্টুমি করলে এখন তাদের বলা যেতে পারে— চুপ! উনিশের ভোট আসছে!

জাতীয় সড়ক থেকে নেমে কোলগাঁও গ্রামের পথ ধরার পর আকবর খানের (ওরফে রাকবর) বাড়ি চিনতে সমস্যা হল না। সীমান্তে গ্রামটিতে শোক আর আতঙ্ক এখন প্রতিটি কোণে।

Advertisement

গো-পাচারকারী অভিযোগে নিহত আকবরের বাবা-মা-স্ত্রী কোনও রকমে নেতিয়ে পড়ে আছেন। গ্রামের প্রবীণরা কাছছাড়া করছেন না তাঁদের। “কেউ এসেছে খবর নিতে? দিল্লিতে নাকি অনেক কিছু হচ্ছে। কিন্তু এখানে তো আমরা আতঙ্ক নিয়েই বেঁচে!” বললেন আয়ুব খান। একটু থেমে যোগ করলেন, “দাড়ি-টুপি নিয়ে এলাকার বাইরে যেতে ভয় করছে ।”

আকবরের বাবা সুলেমান খান ঝিম মেরে বসে। কাঁচা-পাকা বাড়ি। ছড়ানো গোয়াল, বড় বড় জলাধার। আকবর তবু হামলাকারীদের বোঝাতে পারেননি, গরু মারা নয়, গরুর দুধ বিক্রিই তাঁর পেশা। সকাল থেকে রাত খাটিয়াতেই শুয়ে স্ত্রী আসমিনা। পাখার বাতাস করে চলেছেন আকবরের মা হাবিবান। বাচ্চাগুলো অবোধ চোখে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। “দু’বছরের বাচ্চাটা সবে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে শিখেছিল। আকবর সে কী খুশি! দারুণ ইদি (ইদের উপহার) দেবে বলেছিল। সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে গিয়েছিল রামগড়ে...” গলা বুজে এল আসমিনার।

২৫ কিমি দূরে রামগড়। এখানকার লালাওয়ান্ডি গ্রামেই হামলা হয় আকবরের উপর। পুলিশি গড়িমসির অভিযোগ উত্তরোত্তর বাড়ছে। কিন্তু তার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে গোশালা চালানোর নামে অবাধে লুঠ এবং মেরুকরণের অভিযোগ। ঠিক যেমনটা দেখেছি মুজফ্‌ফরনগর বা দাদরিতে গিয়ে। এলাকার পুরনো বাসিন্দা শামিম আহমেদ বলছিলেন, ওঁদের এলাকায় ওঁরা একশো দিনের কাজের সুযোগ পান না। চেয়েচিন্তে মাসে পাঁচ দিনের বেশি কাজ জোটে না। বাকি দিনগুলো দুধ বেচাই ভরসা।

কিন্তু শামিম লক্ষ করছেন, গত ক’বছর যখনই ছোট-বড় ভোট আসছে, তখনই পরিবেশটা পাল্টে যাচ্ছে। হাওয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনা। পরিবহণের খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হুটহাট। ফলে গরু-মোষ নিয়ে রাতের অন্ধকারে চলাফেরা বাড়ছে আর সেই সুযোগে নেমে আসছে আক্রমণ! মারধর, লুঠতরাজ আর শাসানি শুরু হয়ে যাচ্ছে!

একই সুর রহমানের গলাতেও। বললেন, ‘‘প্রজন্মের পর প্রজন্ম দুধ বেচি আমরা। গ্রামের মধ্যে দুই সম্প্রদায়ে কোনও দিন সমস্যা হয়নি। গত ক’বছরে পরিস্থিতি ঘুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘুলিয়ে দিচ্ছে বাইরের লোক।’’ কী রকম? রহমানের ইঙ্গিত গজিয়ে ওঠা গোশালাগুলোর দিকে। তারাই গরু ধরে নিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের পরিবেশ বিষিয়ে দিতে চাইছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হইচইয়ের জেরে রামগড় থানাকে এখন প্রায় দু্র্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছে দিল্লির নির্দেশে! কিন্তু তার নামমাত্র দূরেই যে চৌরা (চার মাথার মোড়), সেখানে ক্ষোভ আর আতঙ্ক মেশানো গুঞ্জন কিন্তু থামেনি। আকবরের ভাই হারুন গ্রামে দাঁড়িয়ে যা বলেছিলেন, চা আর নমকিন বিক্রি করা নাজির আহমেদ তার থেকে অন্য কিছু বলছেন না। “তিন জন গ্রেফতার হয়েছে শুনেছি। কিন্তু কী করে ভুলব এই অলওয়ারেই পেহলু খানের হত্যাকারীরা রেহাই পাওয়ার পর ব্যান্ড বাজিয়ে মালা পরিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করা হল! ভোটের আগে বজরঙ্গ দল বকলমে গোশালাগুলো কাজে লাগাচ্ছে উত্তেজনা উস্কে দেওয়ার জন্য। ওরা অপেক্ষা করে আছে কখন কার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবে, আর ধর্মের নামে সব এককাট্টা হবে।” কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গিয়ে ইশারায় সরে যেতে বললেন নাজির। বাইক-বাহিনী আসছে। চালকদের কপালে লাল-গেরুয়া তিলক। থানা বড়জোর সাতশো মিটার দূরে! জাতীয় সড়কে উঠতে উঠতে মনে হল, গো-বলয়ের ভোটে গরুই ঘুঁটি এ বার!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement