—ফাইল ছবি।
তত ক্ষণে ওদের হাতে এসে গিয়েছে মশাল। চালকের মাথায় পড়েছে রেঞ্চের বাড়ি। ঝরছে রক্ত। সামনে গাড়ি জ্বলছে। রাস্তায় পড়ে লাশ। মনে হল, হয়তো বাড়ির লোকের সঙ্গে আর দেখা হবে না। বিদেশেই পড়ে থাকবে আমারও মরদেহ। কিন্তু দুই ফেরেস্তার দয়ায় ঘরের ছেলে ঘরেফিরতে পেরেছি।
অসমের শিবসাগরের জেঙানি কটিয়ার ছেলে আমি। বাবা অনেক আশায়, ডাক্তার হওয়ার জন্য ঢাকায় ডেল্টা মেডিক্যাল কলেজে আমায় ভর্তি করিয়েছিল। মাত্র এক মাস আগে শুরু হয়েছিল ক্লাস। অসমেরও আরও কয়েক জন ছাত্র পেয়ে গেলাম ওখানে। দিব্যি লেখাপড়া করছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই যে সে দেশ এ ভাবে অগ্নিগর্ভ হতে পারে, তেমন কোনও লক্ষণই ছিল না। প্রথম যে দিন কলেজে আধবেলার ছুটি দিল সে দিন গোলমাল আঁচ করলাম। স্থানীয় ছাত্রেরা আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল, “কলেজে আর আসবি না এখন। ঝামেলা হতে পারে।” ভাগ্যিস তার পরেই বাড়িতে ফোন করে টাকা পাঠাতে বলেছিলাম।
হঠাৎই আদালতের রায়ে চরম গন্ডগোল শুরু হল। ছাত্রাবাসে আটকে পড়লাম অসমের ৫ জন। আমাদের মধ্যে যে সিনিয়র সে বলল বিমানের টিকিট এখনও পাওয়া যাচ্ছে, পালাতে হলে এখনই কাটতে হবে। দোলাচলের মধ্যেই টিকিট কেটে ফেললাম। ভাগ্যিস! কিছু ক্ষণের মধ্যেই নেট সংযোগ কেটে দেওয়া হল। তার পর থেকে বাড়ির সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ।
আমাদের ফেরার টিকিট ছিল ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু বেরোব কী ভাবে। বিমানবন্দর তো অনেক দূর। সাহায্যের হাত বাড়াল স্থানীয় এক বন্ধু। ১৮ জুলাই রাত ৮টায় একটা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে সে হাজির। ছাত্রাবাস থেকে আমরা ১৫ জন তার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে উঠলাম। অ্যাম্বুল্যান্স প্রথমে থামল একটা নার্সিংহোমে। সেখানেই আমাদের জন্য খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাত ৩টে নাগাদ ফের বেরোনো হল বিমানবন্দরের দিকে। ভয় ছিল আন্দোলনকারীদের অবরোধের।
আশঙ্কাই সত্যি হল। দেখলাম রাতের রাস্তাতেও গাড়ি ধরে ধরে তল্লাশি চলছে। বাদ গেল না আমাদের অ্যাম্বুল্যান্সও। চালকের কাছে জানতে চাইল এত জন রোগী কোথায় যাচ্ছে? দরজা খুলে ছাত্র দেখেই চালককে মারতে শুরু করল ওরা। তাঁর মাথায় রেঞ্চ দিয়ে সপাটে মারতেই বেরিয়ে এল রক্ত। ভাঙতে থাকল অ্যাম্বুল্যান্স। তার পর নিয়ে এল আগুন।সামনের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় পড়ে সেই গাড়ির আরোহীদের মৃতদেহ।
স্থানীয় ওই বন্ধু ফের বিপত্তারণ হয়ে দেখা দিল। আন্দোলনকারীদের পায়ে ধরে অনুরোধ করল ভারতীয় ছাত্রদের যেন প্রাণে না মারা হয়। শেষ পর্যন্ত কাজ হল। আন্দোলনকারীরা রাস্তা ছাড়তেই গুরুতর জখম গাড়ির চালক ঘুরপথে বেপরোয়া গাড়ি ছোটালেন। বিমানবন্দরে আমাদের নামিয়ে ফিরে গেলেন ওঁরা।
সেখানে ঢুকে নিরাপত্তা তো পেলাম, কিন্তু বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা পাচ্ছিলাম না। বারবার ফেরার বিমানের সময় বদলাতে লাগল। ১৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পরে আমাদের ১৪ জন কলকাতার একটি বিমানে ও অন্যেরা অন্য এক বিমানে উঠতে পারলাম। আসার আগে ওই স্থানীয় বন্ধু পই পই করে বলে দিয়েছে, সে সবুজ সঙ্কেত না দেওয়া পর্যন্ত যেন ঢাকায় পা না রাখি।
ফিরতে পেরেছি স্থানীয় ওই বন্ধু আর গাড়িচালকের কল্যাণে। তাঁরাই আমার কাছে ফেরেস্তা।
(লেখক: বাংলাদেশ-ফেরত ছাত্র)