তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পরে এ বার ঘরে ফেরার পালা। শনিবার দিল্লির টিকরি সীমানায় আন্দোলনকারী কৃষক। ছবি— পিটিআই।
সিংঘু একটি সভ্যতার নাম!
দিল্লির সীমানায় গত এক বছর ধরে গড়ে ওঠা এই ‘সভ্যতা’ নতুন ভারতের জন্ম দিল। বিদ্বেষের বদলে ‘বিরাদরি’, ধর্মের নামে ভাঙাচোরার বদলে ‘ভাইচারা’।
কৃষক আন্দোলনের শেষ প্রভাতে হাজি মহম্মদ জামিলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন গুরমিত সিংহ, কুলবন্ত রণধাওয়ারা। ‘বড়ি সেবা করি আপনে’ বলতে বলতে চোখ ভিজে এল সবুজ পাগড়িধারী শিখদের। দলবল নিয়ে গাড়িতে ওঠার মুখে হাজি মহম্মদ জানিয়ে গেলেন, এমন ‘ভাইচারা’র ‘খুশিয়াঁ’ সঙ্গে নিয়েই ফিরছেন। তাঁদের বিদায় জানিয়ে নিজেরাও রওনা হওয়ার আগে পারগতদের মন্তব্য, এই ‘বিরাদরি’ গোটা জীবনের স্মৃতি
হয়ে থাকল।
এই ‘ভাইচারা’র ভারত, ‘বিরাদরির’ দেশ কৃষকদের তৈরি। দিল্লির সীমানায় শনিবার সমস্বর, এখানে মোদীর স্বপ্ন দেখানো ‘নতুন ভারতের’ বিজ্ঞাপনী মোড়ক নেই। সাম্প্রদায়িকতা নেই। জাতপাতের বিভাজন নেই। সব বিভাজনের ঊর্ধ্বে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে পেশার জন্য, ডাল-রুটির জন্য লড়াই রয়েছে।
দিল্লি-হরিয়ানা সীমানার সিংঘুতে শিখ, জাঠ কৃষকরা আন্দোলন শুরু করার পরে পঞ্জাবের মালেরকোটলা থেকে এসে লঙ্গর খুলেছিলেন হাজি মহম্মদ জামিল। তাঁর লঙ্গরে রোজ হিন্দু, শিখ, মুসলিমদের একসঙ্গে পাত পড়ত। বাড়ি থেকে কয়েকশো মাইল দূরে তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় বসে থাকা চাষিদের জন্য রান্না হত গরম গরম জর্দা পোলাও। হাজির কথায়, ‘‘সাংগ্রুরের মালেরকোটলা বরাবরই ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের জন্য পরিচিত। সরহিন্দের মুঘল সুবেদার যখন গুরু গোবিন্দ সিংহের পুত্রদের উপর অত্যাচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন মালেরকোটলার নবাবই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছিলেন। আমরা সেই মাটির সন্তান।’’
গাজ়িপুরে গত এক বছর ধরে আন্দোলনে ছিলেন উত্তরপ্রদেশের ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের নেতা পারগত সিংহ। আন্দোলনের শেষ দিনে পারগত বললেন, ‘‘কৃষক আন্দোলন সবাইকে এক করে দিল। কে কোন জাত, ধর্মের, তা ভুলে সবাই শুধু কৃষক। সবাই একটাই পরিবার, একটাই বিরাদরি। মোদীর ভারতের ঠিক উল্টো ছবি।’’
এই ঐক্য কি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ছাপ ফেলবে? পারগতের উত্তর, ‘‘বিজেপি উত্তরপ্রদেশে তো হিন্দু-মুসলমানই করেছে। এ বারও করছে। ওই ধর্মের ভেদাভেদের সঙ্গেই জাত-ধর্ম ভুলে ঐক্যের লড়াই হবে।’’ একই ভাবে মথুরা থেকে আসা কিসান সিংহ নম্বরদর বলছেন, “ওরা (মোদী সরকার) আমাদের যত গালি দিয়েছে, আমরা তত সংগঠিত হয়েছি। জাতি আর ধর্মে ভাগ করে রেখেছিল আমাদের। কিন্তু আজ সংযুক্ত কিসান মোর্চার নীচে আমরা সবাই বুলন্দ। আর আমাদের ফসল লুঠতে
পারবে না।”
২০১৩-য় মুজফ্ফরনগরের সাম্প্রদায়িক হিংসায় পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ বলয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এ বার সেই জাঠ ও মুসলিমরা ফের এককাট্টা। ও দিকে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জাঠদের রাষ্ট্রীয় লোক দল হাত মিলিয়েছে। পারগতের মতে, যাদব-মুসলিম-জাঠ ভোটের বাক্সে এককাট্টা হলে বিজেপির বিপদ। পাশাপাশি সংযুক্ত কিসান মোর্চার অন্যতম নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, ‘‘ব্রিটিশরা ভেদাভেদ করার আগে এ দেশে এমনই ভাইচারা, বন্ধুত্ব ছিল। আবার বোধহয় দু’শো বছর পরে আবার আমরা ধর্ম, জাত ভুলে এমন বন্ধুত্ব দেখলাম।’’
এই ‘বন্ধুত্বের’ মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে আরও তীব্র করবে, এমনটাই অনুমান রাজনৈতিক শিবিরের। ইতিমধ্যেই তালিবান, কবরিস্তানের প্রসঙ্গে উঠেছে। হিন্দু তীর্থস্থানের জন্য যোগী সরকারের দাতব্যও উঠে আসছে প্রচারে। অন্য দিকে বিভাজনের ফাঁদে পা দিয়ে অখিলেশ যাদবও জিন্নার প্রসঙ্গ তুলেছেন।
রাজনৈতিক সূত্রের মতে, কৃষক মন বিগড়ে যাচ্ছে, এটা অন্তর্বর্তী সমীক্ষায় স্পষ্ট না হলে আইন প্রত্যাহার করতেন না নরেন্দ্র মোদী। সে ক্ষেত্রে নতুন একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তিন আইন প্রত্যাহার করার ফলে কি হৃত কৃষকভোট পুনরুদ্ধার করতে পারবে বিজেপি? উত্তরাখণ্ড থেকে গাজ়িপুরে এসে এক বছর আন্দোলন করা কৃষকরা প্রশ্নটিই উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের মতামতের নির্যাস, শুধুমাত্র কৃষি আন্দোলনের কারণে নয়, সব মিলিয়েই বিজেপির পুষ্কর সিংহ ধামির সরকার এবার হারবে। কংগ্রেসের জয় অনিবার্য।
পাশাপাশি, আইন প্রত্যাহার করাটাই অন্নদাতাদের মন জয় করার চাবিকাঠি নয়, সেটাও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে গাজ়িপুরে। আজমগড়ের রাজনীত যাদবের কথায়, “ইংরেজ আমলেও সামনে থেকে গুলি মারত। এরা তো লখিমপুর খেরিতে পিছন থেকে মেরেছে। এদের কালো চেহারা আজ রাজ্যবাসীর সামনে বেরিয়ে পড়েছে। আজ আমরা এখানে সাতশো জন শহিদকে যে রেখে যাচ্ছি, তা কি ভোলা যাবে? কেউ ভুলবে না কাদের জন্য কেন এঁদের প্রাণ দিতে হয়েছে।”