ফাইল চিত্র।
রাজা নেই, রাজপাটও নেই। তবে কাছাড়ে এখনও আছে রাজপরিবারের দেবী দশভুজার মূর্তি। এখনও তিনি আগের মতই পূজিতা হন। ডিমাসা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপ থেকে অষ্টধাতুর এই দশভুজা মূর্তি নিয়ে এসেছিলেন। তখন মাইবাঙে ছিল রাজধানী। রাজবাড়ির মন্দিরেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরে কাছাড় জেলার খাসপুরে রাজবাড়ি স্থানান্তরিত হলে রানিঘাটে তৈরি হয় দশভুজার মন্দির। রাজপণ্ডিত গৌড়মণি চৌধুরী দেবীর পূজা-অর্চনার জন্য সপরিবারে সেখানেই থাকতেন। ১৯৬৭ সালে তাঁর পরিবার রানিঘাট থেকে বড়খলায় চলে এলে দশভুজা দেবীকেও নিয়ে আসেন। এর প্রায় শতবর্ষ আগেই রাজপাট চুকে গিয়েছে। কিন্তু দেবী রয়ে যান রাজপণ্ডিতের পরিবারেই৷ গৌড়মণি চৌধুরীর নাতির নাতি বিক্রম এখন নিত্য পূজা করেন।
প্রতিমার উপরের দিকে ডানে-বামে কৃষ্ণ-বলরাম। মাথার উপরে শিব। কার্তিক-গণেশ সঙ্গে থাকলেও লক্ষ্মী-সরস্বতীর জায়গায় জয়া-বিজয়া। জয়ার একহা তে পদ্মকলি, অন্য হাত অভয় মুদ্রায়। বিজয়ার এক হাতে ঘণ্টা, অন্য হাত উপরের দিকে নৃত্য মুদ্রায়। বিক্রম জানান, মঙ্গলচণ্ডীতে দেবী দুর্গার সন্তান হিসাবে জয়া-বিজয়ারই উল্লেখ রয়েছে। তবে এই অঞ্চলে আর কোথাও দশভুজার সঙ্গে জয়া-বিজয়ার পূজা হয় না। বিক্রম দেখালেন, রাজ আমলের ঘট, বলির যূপকাষ্ঠ, দা, শঙ্খ ইত্যাদি আজও তাঁরা ধরে রেখেছেন। দুর্গাপূজার সময় প্রতিপদে রুপোর কারুকাজ করা ঘটটিই বসানো হয়। তাঁর কথায়, রাজা গোবিন্দচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও দশভুজার পূজা বন্ধ হয়নি।
নিত্য পূজা হয় একই জেলায় বিহাড়া ব্রাহ্মণগ্রামের দশভুজা মন্দিরেও। লোকশ্রুতি রয়েছে, মণিপুরের রাজা কাছাড় আক্রমণ করে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে যান দশভুজা মন্দিরের পিতলের মূর্তিটিও। কিন্তু সে রাতেই রাজা স্বপ্ন দেখেন, দেবী নিজে তাঁকে মন্দিরে রেখে আসার জন্য বলছেন। পর দিন তিনি হাতির পিঠে চড়ে প্রতিমা নিয়ে এসে মন্দিরে রাখেন। সে থেকে দেবী যেমন ডিমাসাদের কাছে পূজিতা, তেমনই মণিপুরিদেরও।
মাইবাং ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মিথিলেশ চক্রবর্তী লিখেছেন, এই অঞ্চলের মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) সম্প্রদায়ের মানুষ দেবী দশভুজার নামে নতজানু। দেবীর মুখদর্শন না করে শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় এঁদের অন্য কোনও প্রতিমার মুখদর্শন না করার প্রথা আজও বর্তমান। রাজ আমলে ডিমাসা-মণিপুরিদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। স্বাধীনতার পর অনুপ্রবেশের প্রশ্নে বাঙালিদের সঙ্গে উভয় জনগোষ্ঠীর একটা সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কাছাড় জেলার দুই দশভুজা মন্দির ডিমাসা, মণিপুরি ও বাঙালিদের একবিন্দুতে নিয়ে আসে। ডিমাসা ও মণিপুরি উভয় জনগোষ্ঠীর মানুষ বিহাড়া এবং বড়খলার দশভুজা মন্দিরের দেবী দুর্গাকে নিজেদের বিশেষ আরাধ্যা বলে মনে করেন। মন্দির দু’টি রয়েছে দুই বাঙালি পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে।