—প্রতীকী চিত্র।
১০ বছরেরও বেশি সময় হয়ে গিয়েছে বিছানা থেকে ওঠেননি ছেলে। কলেজে একটি দুর্ঘটনার পর থেকে স্নায়ুর অসুখে ভুগছেন। শরীরের ১০০ শতাংশই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দিনের পর দিন ছেলের অসহনীয় যন্ত্রণা, নিজেদের আর্থিক অসঙ্গতি এবং মানসিক অবস্থার কথা জানিয়ে আদালতে ছেলের ইচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। যদিও সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে দিল্লি হাই কোর্ট।
চনমনে যুবক ছিলেন হরিশ। মোহালির চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। আচমকা দুর্ঘটনা! ২০১৩ সালে কলেজের চার তলা থেকে পড়ে যান তিনি। প্রাণরক্ষা হলেও শরীরের প্রায় সমস্ত অঙ্গই অকেজো হয়ে যায় তাঁর। মাথার আঘাত ছিল অত্যন্ত গুরুতর। দুর্ঘটনা নিয়ে ‘রহস্য’ রয়েছে বলেই পরিবারের দাবি। থানায় এফআইআর করেন হরিশের বাবা রানা। ছেলের চিকিৎসার জন্য একের পর এক বড় হাসপাতাল ঘুরেছেন। দীর্ঘ দিন চণ্ডীগড়ের পিজিআইতে হরিশের চিকিৎসা হয়েছে। তার পর এমস, রামমনোহর লোহিয়া, লোকনায়ক এবং দিল্লির ফর্টিস হাসপাতালে দেখানো হয়েছে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। ১১ বছরের বেশি সময় বিছানা থেকে ওঠেননি হরিশ। প্রতি দিন ছেলেকে একটু একটু করে বিছানার সঙ্গে মিশে যেতে দেখে দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন হরিশের ৬২ বছরের বাবা রানা এবং মা নির্মলা দেবী। তাঁদের আবেদন, মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে ছেলেকে প্যাসিভ ইউথানাসিয়া (নিষ্কৃতি-মৃত্যু) দেওয়া হোক।
আদালতের কাছে রানা জানান, যখন বাবা-মা তাঁদের সন্তানের মৃত্যু কামনা করে, তখন তা নিষ্ঠুরতা নয়। সেটা আসলে ভালবাসার অভিশাপ। সেই ভালবাসার টানে ছেলের জীবন শেষ করে দেওয়ার অনুমতি চাইছেন আদালতের কাছে। সন্তানের শারীরিক কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মানসিক এবং আর্থিক অবস্থার কথা হাই কোর্টে তুলে ধরেছেন রানা। তিনি বলেন, ‘‘ছেলের ২৪ ঘণ্টা দেখাশোনার জন্য এক জন নার্স রাখতে হয়। মাসে তাঁর পারিশ্রমিক ২৭ হাজার টাকা। আর আমাদের সবার মাসিক উপার্জন ২৮ হাজার টাকা।’’ বেসরকারি চাকুরে রানা জানান, এখানেই শেষ নয়। ছেলের চিকিৎসার জন্য এক জন ফিজ়িওথেরাপিস্ট রয়েছেন। তাঁকেও ১৪-১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। বছরের পর বছর সন্তান এবং তাঁদের কষ্ট বেড়ে চলেছে, ব্যয়বৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু, ছেলের ভাল হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না। চিকিৎসকেরাও কোনও আশার কথা শোনাতে পারেননি। রানা বলেন, ‘‘হরিশের চিকিৎসা, ওষুধপত্রের জন্য যে ব্যয়ভার, তা বহন করতে পারছি না।’’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলের হরিশ। ওইটুকুই। হাই কোর্টে হরিশের বাবা-মায়ের আর্তি, ‘‘কী করে আমরা বেঁচে আছি, তা কেবল আমরাই জানি। অন্যের প্রাণরক্ষা করতে নিজেদের অঙ্গ দান করব আমরা। অন্তত এটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, সেই মানুষটি ভাল ভাবে বেঁচে রয়েছে।’’
২০২১ সালে রানা তাঁদের তিন তলা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই কথাও আদালতে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ওই জায়গাটিকে বাড়ি বলে জানতাম ১৯৮৮ সাল থেকে। চার দেওয়ালের মধ্যে আমাদের— স্বামী-স্ত্রী-ছেলের অসংখ্য স্মৃতি ছড়িয়ে ছিল। আমাদের ওই জায়গায় অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছতে পারত না। ছেলের চিকিৎসার সুবিধার্থে এবং নিজেদের মানসিক শান্তির খোঁজে সেটুকুও বিক্রি করে দিয়েছি।’’
এখন মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা পেনশন পান রানা। ওই টাকায় সংসার চালাবেন কী ভাবে আর ছেলের চিকিৎসা করাবেন কী দিয়ে! তাই এখন স্যান্ডউইচ তৈরি করে পাড়ায় বিক্রি করেন রানা ও তাঁর স্ত্রী। ছোট ছেলে আশিস সদ্য একটি চাকরি পেয়েছেন। তাতে কোনও রকম ভাবে চলছে।
গত ৮ জুলাই আদালত রানার আবেদন খারিজ করে দিয়ে জানিয়েছে, আমাদের দেশের আইন ইচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেয় না।