দেবিকা রোটাওয়ান (বাঁ দিকে) এবং আকাশ আকিনওয়ার (ডান দিকে)।
আরব সাগর হয়ে বাণিজ্যনগরীতে ঢুকে পড়েছিল ওরা। ঠিক ১৫ বছর আগে। একের পর এক অতর্কিত হামলায় গোটা দেশের হৃৎস্পন্দন যেন থমকে গিয়েছিল কিছু সময়। দেড় দশকে ক্রমশ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে মুম্বই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ক্ষত এখনও দগদগে।
২৬/১১-র সময়ে দেবিকা রোটাওয়ানের বয়স মাত্র নয়। বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস (সিএসটি) স্টেশনের ১২ ও ১৩ নম্বর স্টেশনের মাঝে পুণের ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎই দেখেন, নির্বিচারে গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে চলেছে এক
জঙ্গি। চোখের সামনেই কেউ লুটিয়ে পড়ে, কারও জামা ভিজে যায় রক্তে। ঘোর কাটার আগেই একটি বুলেট ঢুকে যায় পা ফুঁড়ে। ফোনে দেবিকা বলেন, “পুলিশকাকুরা প্রথমে সেন্ট জর্জ’স হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। পরে জে জে হাসপাতালে পা থেকে গুলি বার করা হয়। পায়ের হাড় ভেঙেছিল। মনটাও চুরমার হয়ে গিয়েছিল। আজও ওদের ক্ষমা করতে পারিনি।” পরে আর্থার রোড জেলে গঠিত বিশেষ আদালতে শুনানির সময়ে আজমল কসাবকে শনাক্ত করেন ওই কন্যাই।
আদালতে কসাবকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন? “ভয় কী বলছেন, রাগ বলুন। ওই বয়সেই মনে হয়েছিল, ছুটে গিয়ে গুলি করে দিই। তবে এটা সত্যি প্রথম বার স্টেশনে বন্দুক হাতে ওই লোকটাকে দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম। ওর ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু এখনও কসাবের কথা মনে পড়লে রাগ হয়। অবশ্য শুধু ওর উপরে রাগ করে কী হবে। এর জন্য মূল দায়ী যারা ষড়যন্ত্র করেছিল। যারা পাকিস্তানে বসে সন্ত্রাসে মদত দিচ্ছে, তাদের উপরে রাগ হয়। এই কুচক্রীদের মুছে না ফেললে ‘ইনসাফ’ মিলবে না। ১৫ বছর কাটলেও আমি কিচ্ছু ভুলিনি। ২৬/১১-কে ভুলে গেলে মনে হবে সন্ত্রাসবাদকেই ক্ষমা করে দিয়েছি। সে দিনের গুলির চিহ্ন আজও বয়ে চলেছি। এখনও পায়ে ব্যথা করে। ফের চলাফেরা শুরু করলেও সবটা স্বাভাবিক হয়েছে কি?”
সেন্ট জর্জ’স হসপিটালের দাঁতের চিকিৎসক এবং অধ্যাপক আকাশ আকিনওয়ার অবশ্য বলেন, “প্রথম ৫-৬ বছর ওই ঘটনা তাড়া করলেও ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়েছে।” ঘটনার দিন লিওপোল্ডে কাফের উল্টো দিকের এক রেস্তরাঁয় নৈশভোজে গিয়েছিলেন আকাশ। প্রথমে ভেবেছিলেন বাজি ফাটছে। ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ওয়েটার জঙ্গিহানার খবর দিতেই টেবিলের তলায় সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন। গুলির আওয়াজ থামতে রেস্তরাঁ থেকে বেরোন। দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে অনেকে। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেন।
আকাশের কথায়, “সেই সময় হাসপাতালে লোকবল কম। বন্ধুরা মিলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। রক্তও দিয়েছি।” ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও আকাশের কথায়, “এ ভাবে দেখি না। আমরা বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। সেই সময়ের কী পরিস্থিতি তা বোঝানো সম্ভব নয়। ধরুন, আপনি কলকাতার কোনও রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছেন। পিছন থেকে গুলি চলছে! অনেকের জামা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। নিজে হাতে দেহ সরিয়েছি।”
তবে ২৬/১১-র পরে বদলে গিয়েছে সবকিছু। বেড়েছে নিরাপত্তা। আকাশের কথায়, “শুধু মুম্বই কেন, গোটা দেশেই তেমন ঘটনা আর ক’টা ঘটেছে! এখন এ শহর অনেক নিরাপদ, শান্ত। তবে আর কোনও দিন কিছু হবে না, এমনটা আশা করবেন না। পুলওয়ামায় যা হল। প্রতিবেশীর সন্ত্রাসে মদত, বিরাট মানুষের ভিড়— ফলে যা কিছু হতে পারে। শুধু প্রতিবেশীর উপরে দোষ চাপালেও হবে না, এ দেশেও তো কয়েকটা লোক জঙ্গিদের মদত দিয়েছে। এত বড় দেশে নিরাপত্তার সামান্য বিচ্যুতিও বড় ক্ষতি করে দিতে পারে।”
দেবিকাও বলেন, “তখনও মুম্বই লড়েছিল। কখনও এমন হলে আবার লড়বে। ভারত সরকারের উপরে বিশ্বাস আছে।” তবে ১৫ বছরে দেবিকার জীবন অনেকটাই বদলেছে। সেই ঘটনার পরে এখন অভাব-অনটন নিত্য সঙ্গী। ২৬/১১-র পরে বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন মুম্বইয়ের চেতনা কলেজে স্নাতক স্তরে পড়ছেন। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসদমন বিভাগের অফিসার হতে চান তিনি।
আর্থিক সমস্যায় সরকারি সাহায্য পেয়েছিলেন? দেবিকা জানান, ওই ঘটনার পরেই সরকারের তরফে সওয়া ৩ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। পরে দেবেন্দ্র ফডণবীস মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ১০ লক্ষ টাকা পেয়েছেন। তবে সেই সময়ে রক্ত কমে গিয়ে প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার পিছনেই সব খরচ হয়ে গিয়েছে। লকডাউনেও অনেকে সাহায্য করেছেন। তবে কসাবকে শনাক্তের পরে কাছের মানুষরাও ভয়ে যোগাযোগ রাখতেন না। যদি পাল্টা হামলা হয়। এখন সরকার থেকে আদালতের দরজায় ঘুরছেন একটা পাকা ছাদের আশায়।
দেবিকার মতোই ১৫টা বছর সন্ত্রাসের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন ২৬/১১-য় নিহত পুলিশ অফিসার অশোক কামতে, বিজয় সালাসকরের স্ত্রীরা। বিজয়-পত্নী স্মিতা ফোনে বললেন, “ওই দিনগুলো আর মনে করতে চাই না। যন্ত্রণা দেয়।” ফোনে একই প্রতিক্রিয়া অশোক জায়া বিনীতারও। তিনি বলেন, “আপনারা এখনও আমাকে মনে রেখেছেন? ধন্যবাদ। কিন্তু এ সব নিয়ে কিছু বলতে আর ভাল লাগে না।”
কিছু ক্ষত থেকে যায়। দেবিকার কথাতেও তারই ইঙ্গিত, “আসলে ৯ বছরের এক বালিকা যে হাসতে-খেলতে ভালবাসত, ওই একটা রাত তার শৈশব কেড়ে নিয়েছে।”