বর্তমান বছরে (বাংলা ৫ বৈশাখ ১৪২৬ সন, শুক্রবার, ইংরাজি ১৯ এপ্রিল ২০১৯) হনুমানজির আবির্ভাব তিথি। এই দিনটিকে ‘হনুমান জয়ন্তী’ বলা হয়। হনুমান ছিলেন রুদ্র অবতার। বলা হয়, একদা দশানন রাবণ কৈলাশে দ্বার পাহারারত নন্দীকে ব্যাঙ্গ করলে, ক্ষিপ্ত হয়ে নন্দী রাবণকে অভিশাপ দিলেন, নর আর বানরের হাতেই রাবণ আর তার কূল ধ্বংস হবে। রাক্ষস বাহিনীর অত্যাচার থেকে ধরিত্রীকে মুক্ত করতে, তথা ভগবান রামের সেবা ও রাম নাম প্রচারের জন্যই রুদ্র অবতার হনুমানের আবির্ভাব। হনুমানের পিতার নাম ছিল কেশরী, মায়ের নাম ছিল অঞ্জনা। হনুমানের পালক পিতা হলেন পবন দেবতা। ছোটোবেলা থেকেই হনুমানজি অতি চঞ্চল ছিলেন। পুরান অনুসারে একদা তিনি সূর্য দেবতাকে ফল হিসাবে গ্রাস করে ফেলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দ্র দেবতা হনুমানকে বজ্রাঘাত করে সূর্য উদ্ধার করেন। বজ্রের আঘাতে হনুমান অচেতন হলে, তাঁর পালক পিতা পবন দেবতা ক্রুদ্ধ হয়ে সমস্ত রকম বায়ু রোধ করলে এক মহাবিনাশের উপক্রম হয়। এরপর ব্রহ্মা ও অনান্য দেবগণ হনুমানকে সুস্থ করে নানান আশীর্বাদ প্রদান করেন। হনুমান চার যুগে অমর, পুরাণে তাই বলা হয়।
শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন হনুমান। সীতার অপহরণের পর হনুমানের উদ্যোগে রামচন্দ্রের সঙ্গে বানর রাজ বালীর ভাই সুগ্রীবের বন্ধুত্ব হয়।বালী আবার নিজ ভ্রাতা সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে অপহরণ করে বন্দী করে রেখেছিলেন। রামচন্দ্র বালীকে বধ করে সুগ্রীবকে বানর জাতির রাজা বানান। হনুমান প্রথম অপহৃতা মা সীতার সংবাদ আনেন। ভগবান রামচন্দ্রের লঙ্কা আক্রমণ কালে হনুমান নিজে প্রচুর রাক্ষস সৈন্য, বড় বড় রাক্ষস বীরদের বধ করেন এবং যুদ্ধে আহত লক্ষণ এর প্রাণ বাঁচাতে তিনি গন্ধমাদন পর্বত তুলে আনেন। এ ভাবে হনুমান ভগবান রামচন্দ্রের সেবা করেন। হনুমানজির প্রবল ভক্তির একটি কথা পুরাণে পাওয়া যায়। রামচন্দ্র তখন রাক্ষস বাহিনী আর রাবণকে বধ করে ভাই লক্ষণ ও সীতাকে নিয়ে ১৪ বছর বনবাস শেষে অযোধ্যাতে ফিরেছেন। এই সময় সীতা হনুমানকে একটি মুক্তার মালা উপহার দিলেন। ভক্ত হনুমান মালাটি নিয়ে দেখে, নেড়ে চেড়ে ছিঁড়ে মুক্তোগুলো দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ফেলে দিলেন। সকলে অবাক হল। ভাবলেন, বনের পশু মুক্তার মালার মর্ম কী জানে? সকলে হনুমানকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “যাহাতে রাম নাম নেই তাহাতে কী প্রয়োজন?” সকলে বললেন, “তাই যদি হয় তবে তোমার অন্তরে কী রাম নাম আছে? থাকলে দেখাও।” এই শুনে হনুমানজী নিজের নখ দিয়ে নিজের বুক বিদীর্ণ করলেন। সকলে দেখলেন সেখানে রামচন্দ্র ও মা সীতা বিরাজমান। হনুমানজির এই শিক্ষা আমাদের পথ দেখায়। যাতে ভগবানের নাম নেই, যেখানে ভগবানের নাম কীর্তন হয় না, সেই স্থান পরিত্যাগ করা উচিত।
হনুমানজী দ্বাপর যুগেও ছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেছেন। হনুমানজীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ রামচন্দ্রের রূপ ধারণ করে হনুমানকে একবার দর্শন দিয়েছিলেন। বলা হয়, হনুমান পরম বৈষ্ণব, ভগবান হরির প্রিয় ভক্ত। একটি মন্ত্রে বলা হয়:
যত্র যত্র রঘুনাথকীর্তনং তত্র তত্র কৃতমস্তকাঞ্জলিম্ ।
বাষ্পবারিপরিপূর্ণলোচনং মারুতিং নমত রাক্ষসান্তকম্ ।।
আরও পড়ুন: হনুমান জয়ন্তীতে কী ভাবে পুজো করলে সমস্যা দূর হবে
অর্থাৎ যেখানে যেখানে রঘুনাথের গুণগান করা হয়, সেখানে সেখানেই যিনি মস্তকে অঞ্জলি স্থাপনপূর্বক সাশ্রুনয়নে অবস্থান করেন, সেই রাক্ষস বিনাশী মারুতিকে (হনুমান) সকলে নমস্কার করুন।
হনুমানজীর প্রণাম মন্ত্র:
মনোজবং মারুততুল্যবেগং
জিতেন্দ্রিয়ং বুদ্ধিমতাং বরিষ্ঠম্ ।
বাতাত্মজং বানরযূথমুখ্যং
শ্রীরামদূতং শিরসা নমামি ।।
অর্থাৎ যিনি মন ও বায়ূর ন্যায় দ্রুতগামী, বুদ্ধিমান, ব্যাক্তিদিগের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং বানর বাহিনীর অধিনায়ক, সেই শ্রীরামের দূত, জিতেন্দ্রিয় পবন নন্দনকে অবনত মস্তকে নমস্কার করি।