যে দেহপট নিয়ে আমাদের দিবারাত চিন্তাভাবনার শেষ নেই, তাকে ‘টক্সিন ফ্রি’, অর্থাৎ বিষমুক্ত করতে গ্রিন টির উপর ভরসা করেন স্বাস্থ্যসচেতনেরা। আবার গত কয়েক বছরে দারচিনি ভেজানো জলেরও জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অনেকেই ইদানীং ঘুম থেকে ওঠার পরে দিনের প্রথম পানীয় হিসাবে খাচ্ছেন আগের রাত থেকে ভিজিয়ে রাখা দারচিনির জল। কিন্তু কখনও এই দু’টি পানীয়কে একসঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার কথা ভেবেছেন কি?
গ্রিন টি এবং দারচিনি
ভারতীয় মশলা চায়ে দুধ, চিনি, চা পাতার সঙ্গে এলাচ, দারচিনি এবং লবঙ্গ দেওয়ার চল বহু দিনের। ফলে চায়ের পাতার সঙ্গে দারচিনির যোগাযোগ নতুন নয়। তবে গ্রিন টির সঙ্গে দারচিনি মেলানো উচিত কি না, তা বুঝতে হলে একটু গোড়ায় পৌঁছতে হবে।
গ্রিন টি: গ্রিন টি-র জনপ্রিয়তা মূলত এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসের জন্য। এতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ক্যাটেসিন, যার মধ্যে অন্যতম এপিগ্যালো ক্যাটেসিন গ্যালেট বা ইজিসিজি। এই ইজিসিজি শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে দিতে পারে।
যেহেতু অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হওয়ার অর্থ শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যালসের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং ফ্রি র্যাডিক্যালস বার্ধক্য থেকে শুরু করে হার্টের রোগ-সহ নানা ধরনের রোগ এবং কোষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ, তাই গ্রিন টি খেলে শরীর সুস্থ থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গ্রিন টি শরীরে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের মাত্রা কমাতে এবং ‘ভাল’ কোলেস্টেরলের ভারসম্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।
দারচিনি: রান্নায় ব্যবহার করার সুগন্ধি মশলা দারচিনিও কোলেস্টেরল কমাতে পারে বলে জানিয়েছে বহু গবেষণা। গবেষকেরা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন, দারচিনিতে রয়েছে বিভিন্ন জৈব সক্রিয় উপাদান, যার মধ্যে অন্যতম সিনামালডিহাইড। এটিই কোলেস্টেরল কমাতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বহু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোলেস্টেরলের পাশাপাশি লিপিড প্রোফাইলের অন্য ক্ষেত্রগুলির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও কাজ করেছে দারচিনি।
একসঙ্গে মেলালে কী হবে?
যেহেতু গ্রিন টি এবং দারচিনি— উভয়েই কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই দু’টি একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে কাজ আরও বেশি হবে কি না, তা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। তেমনই একটি গবেষণাপত্রে দেখা গিয়েছে গ্রিন টি এবং দারচিনি একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে তা কোলেস্টেরল দ্রুত কমাতে সাহায্য করেছে। ‘জার্নাল অফ ক্লিনিকাল লিপিডোলজি’তে ওই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিতও হয়েছে। তাতে লেখা, ‘‘গ্রিন টি এবং দারচিনি একযোগে হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করবে। এমনকি, এই দুই উপাদান নিয়মিত শরীরে গেলে হার্টের রোগের আশঙ্কাও অনেক কমে যেতে পারে।’’
কী ভাবে হার্টের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করবে ওই পানীয়?
গবেষণায় যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, দেখা গিয়েছে, নিয়মিত গ্রিন টি খাওয়ার পরে তাঁদের এলডিএল-এর মাত্রা চোখে পড়ার মতো কমেছে। পরে যখন তাতে দারচিনি দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে, তখন ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল তো কমেছেই, পাশাপাশি গবেষকদের ধারণা, ওই দুই উপকরণ মেশানো পানীয় খাওয়ার পরে শরীরের এইচডিএল অর্থাৎ ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রাও বাড়বে। কমবে ট্রাইগ্লিসারাইড। অর্থাৎ হার্টের রোগকে দূরে রাখার জন্য লিপিড প্রোফাইলের যে সমস্ত মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলা হয়, তার সবটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা।
আর কী কী উপকার?
হার্ট ভাল রাখার পাশাপাশি দারচিনি দিয়ে তৈরি গ্রিন টি-র আরও নানা উপকারিতা রয়েছে।
১। এটি বিপাকের হার বৃদ্ধি করতে পারে, যা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক।
২। ডায়াবিটিস শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দারচিনি দেওয়া গ্রিন টি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ডায়াবিটিসকে দূরে রাখে।
৩। ওই চায়ের প্রদাহ রোধের ক্ষমতাও আছে। ফলে শরীরে ব্যথা বা জ্বালার সমস্যা থেকেও সুরাহা মিলতে পারে।
৪। যেহেতু দারচিনি এবং গ্রিন টি উভয়েই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসে ভরপুর, তাই কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রেও তা কার্যকরী।
কী ভাবে দারচিনি দিয়ে গ্রিন টি খাবেন?
দারচিনির গুঁড়ো বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, গ্রিন টি বানানোর পরে তাতে আধ চা-চামচ বা এক চা-চামচ দারচিনি গুঁড়ো মিশিয়ে নিয়ে খেতে পারেন। বাজার থেকে না কিনতে চাইলে বাড়িতেও দারচিনির গুঁড়ো বানিয়ে নিতে পারেন। আবার গরম জলে দারচিনির টুকরো আর গ্রিন টি ভিজিয়ে সেই পানীয়ও খেতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, দারচিনির মাত্রায় পরিমিতি বজায় রাখা প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিমাণে দারচিনি খেলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে।
সতর্কতা
সাধারণত যে ধরনের দারচিনি বাজারে পাওয়া যায় সেগুলিকে বলা হয় ক্যাসিয়া। এই ধরনের দারচিনি অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে তা লিভারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্যাসিয়া দারচিনির গুঁড়ো খেতে হবে অল্প পরিমাণে। অন্য ধরনের দারচিনির নাম সেইলন। এটি লিভারের পক্ষে ততটাও ক্ষতিকর নয়। যদিও অতিরিক্ত পরিমাণে কোনওটিই খাওয়া সমীচীন নয়। পুষ্টিবিদেরা বলছেন, প্রথম প্রথম সপ্তাহে দু’-তিন বার খান। পরে ধীরে ধীরে নিয়মিত খেতে পারেন। তবে একটানা খাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি দিন ১ থেকে ২ গ্রামের বেশি ক্যাসিয়া দারচিনি খেতে বারণ করছেন পুষ্টিবিদেরা। নিয়মিত ওই পরিমাণে টানা ২ মাস দারচিনি খাওয়া যেতে পারে। তবে খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াও বাঞ্ছনীয়।