হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ কী কী? ছবি: সংগৃহীত।
থাইরয়েড হল ঘাড়ের নীচে এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের একটি প্রজাপতি আকৃতির ছোট গ্রন্থি। এই থাইরয়েড গ্রন্থি এমন হরমোন তৈরি করে, যা শরীরের বিপাক প্রক্রিয়াকে (মেটাবলিজম) প্রভাবিত করে এবং শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। হাইপোথাইরয়েডিজম হল এমন একটি অবস্থা যেখানে, থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত হরমোন উৎপাদন করে না। তাই হাইপোথাইরয়েডিজমকে আন্ডারঅ্যাকটিভ থাইরয়েডও বলা হয়।
হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলি হল
১) ওজন বৃদ্ধি
২) ক্লান্তি বোধ করা
৩) মুখ, হাত ও পায়ে ফোলা ভাব
৪) গাঁটে ব্যথা এবং শক্ত অনুভব করা
৫) পেশীতে ব্যথা, টান অনুভব এবং শক্ত হয়ে যাওয়া
৬) শুষ্ক ত্বক এবং চুল
৭) ফোলা ভাব এবং কোষ্ঠকাঠিন্য
৮) মেজাজের পরিবর্তন
৯) বিষণ্ণতা
১০) ধীর হৃদ্স্পন্দন
১১) ঠান্ডা তাপমাত্রার প্রতি অসহিষ্ণুতা
১২) ঘাম কমে যাওয়া
১৩) ভুলে যাওয়া
১৪) কর্কশ কণ্ঠস্বর
১৫) রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া
১৬) ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং টাইপ-2 ডায়াবেটিস
১৭) হাইপার ইউরিসেমিয়া
১৮) গাউটি আর্থ্রাইটিস
১৯) অনিয়মিত মাসিক হওয়া
হাইপোথাইরয়েডিজম আপনার বিপাকহার কমিয়ে দেয়, যা শরীরের অবাঞ্ছিত চর্বি বাড়ার প্রধান কারণ। সুতরাং, হাইপোথাইরয়েডিজমকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমিয়ে সঠিক ওজন ধরে রাখতে, ওষুধের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ভারসাম্যপূর্ণ/ব্যালেন্সড ডায়েট এবং ভাল জীবনধারা মেনে চলা খুবই প্রয়োজন। এক জন অভিজ্ঞ ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন যিনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী খাবারের তালিকা তৈরি করে দিতে পারবেন।
হাইপোথাইরয়েডিজম ও ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে, সঠিক ডায়েট ও জীবনধারা খুবই বড় ভূমিকা পালন করে। তার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ টোটকা দেওয়া হল।
● আপনার প্রোটিন গ্রহণ বৃদ্ধি করুন। যেমন ছানা, রাজমা, কাবলি চানা এবং বিভিন্ন ডাল, ডিম, মাছ বেশি করে খান। প্রোটিনে সমৃদ্ধ ডায়েট আপনার বিপাকহার বাড়াতে সাহায্য করবে।
● খাদ্যতালিকায় সব সময়ে ফাইবার সমৃদ্ধ কার্বোহাইড্রেট যেমন ব্রাউন রাইস, রেড রাইস, বিভিন্ন মিলেট্স, কুইনোয়া, ওট্স অন্তর্ভুক্ত করুন।
● হেল্দি ফ্যাট সব সময়ে থাইরয়েডকে সঠিক ভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। তাই গরুর দুধের ঘি, নারকেল তেল, তিলের তেল, বাদাম এবং বিভিন্ন বীজ খাদ্য তালিকায় রাখুন।
● আপনার যদি আয়োডিনের ঘাটতি থাকে, তবে অবশ্যই আয়োডিনে সমৃদ্ধ খাবার যেমন আয়োডিনযুক্ত লবণ, দুধ, ডিম, সামুদ্রিক মাছ, সামুদ্রিক শৈবাল (সিউইড) খান।
● ব্রাজিলিয়ান নাট্স, সার্ডিন, টুনা, ডিম, ডাল, ওটমিল, ব্রাউন রাইসের মতো সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান। কারণ সেলেনিয়াম থাইরয়েড গ্রন্থি সক্রিয় করতে সাহায্য করে।
● জিঙ্কও থাইরয়েড গ্রন্থি সক্রিয় করতে সাহায্য করে। তাই ছোলা, কাজু, কুমড়োর বীজ, দই, চিংড়ি, ঝিনুক, কাঁকড়া, মুরগির মাংসের মতো খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন আপনার ডায়েটে।
● সয়াবিন থেকে তৈরি যে কোনও জিনিস, কাঁচা বাঁধাকপি, ব্রকোলি, কাঁচা চিনাবাদাম, পীচ, পাইন বাদামের মতো গয়েট্রোজেন যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। কিন্তু আপনি যদি এই খাবারগুলি খান, তবে পরিমিত পরিমাণে খান এবং তাও কাঁচা নয়, সেগুলি ভাল ভাবে সেদ্ধ ও রান্না করে খান।
হাইপোথাইরয়েডিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের মরসুমি শাকসবজি, ফল, ব্রাউন রাইস, কুইনোয়া, ওট্স, মটরশুঁটি, মসুর ডাল, ছোলা, রাজমা, কম ফ্যাটযুক্ত মাংস, বাদাম এবং বিভিন্ন বীজ, দই, লো-ফ্যাট পনিরের মতো স্বাস্থ্যকর খাবারের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ক্যালোরি লিমিট-এর মধ্যে ডায়েট করা উচিত। এ ছাড়াও, তাদের অবশ্যই প্রসেস্ড, জাঙ্ক, প্যাকেজ্ড এবং চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
হাইপোথাইরয়েডিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সঠিক সময়ে ঘুম খুবই প্রয়োজন। তাই রাত জেগে নেটফ্লিক্স, ইউটিউব না দেখে আপনার দৈনন্দিন রুটিনে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার সঠিক সময়ে ঘুম অন্তর্ভুক্ত করুন।
এ ছাড়াও নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং কমপক্ষে ২-৩ দিনের স্ট্রেন্থ/ওয়েট ট্রেনিং এবং ২-৩ দিনের কার্ডিয়ো যেমন হাঁটা বা সাঁতার কাটা প্রতি সপ্তাহে অন্তর্ভুক্ত করুন এবং সারা দিন সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন।
প্রচুর পরিমাণে জল খান। এ ছাড়া গ্রিন টি, ডাবের জল, ছাঁচ খেতে পারেন। মদ্যপান এবং ধূমপান একেবারেই বন্ধ করুন।
স্ট্রেস যুক্ত জীবন থাইরয়েডের কার্যকারিতাকে খারাপ ভাবে প্রভাবিত করে এবং সে জন্য দ্রুত ওজন বৃদ্ধি হয়। তাই মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধ্যান, যোগাসন, শ্বাসের ব্যায়াম নিয়মিত ভাবে করুন। অবসর সময়ে আপনার শখগুলি উপভোগ করুন, যেমন গান শোনা, বাগান করা ইত্যাদি। এতে আপনি স্ট্রেস মুক্ত থাকবেন।
ধারাবাহিকতার সঙ্গে এই ঘরোয়া এবং সহজ পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করলে আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবেন। এতে আপনার বিপাকহারও উন্নত হবে এবং সহজেই ওজন কমবে। হাইপোথাইরয়েডিজমের সঙ্গে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে একটু সময় লাগে, তাতে অস্থির হয়ে কখনওই দ্রুত সমাধান বা ফ্যাড ডায়েট ফলো করবেন না, এর ফলাফল ক্ষণস্থায়ী এবং পরবর্তী কালে ক্ষতিকারক হতে পারে। একমাত্র পুষ্টি যুক্ত ব্যালান্সড ডায়েট এবং ভাল জীবনধারাই আপনাকে স্থায়ী ভাবে ওজন কমাতে এবং হাইপোথাইরয়েডিজমকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে।