Ayurvedic Tips for Summer

কেবল দহনজ্বালা নয়, পুরাণ ও বেদের শিক্ষা আমাদের দিতে পারে এক নতুন জীবনশৈলী, যা এখন পশ্চিমের নজরে পড়েছে

বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা এক বার তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিলেন, ‘সবই (নাকি) ব্যাদে লেখা আছে।’ তা যে আসলেই সত্যি তারই প্রমাণ ভারতীয় পুরাণ ও বেদের ছত্রে-ছত্রে।

Advertisement

দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৪ ০৭:৫৮
Share:

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

‘বসন্ত গ্রীষ্মবর্ষেষু অগ্নির্জ্বলতি দেহিনাম্।’

Advertisement

বসন্ত ও গ্রীষ্মের সময় শরীরে যেন আগুন জ্বলে। একে তো এখন ভোটের গরম, তার পরে কাগজ, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন পোর্টালে চোখ রাখলেই সব ছাপিয়ে সবার অন্তরের যাতনার অসহায় প্রতিফলন— ‘প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে/ বায়ু করে হাহাকার’।

গত পঞ্চাশ বছরে নাকি চলতি মরসুমেই ছুঁয়েছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে অসহ্য গরম পড়লেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। তাই নিষাদরাজ নলের ‘পাকদর্পণ’-এও গ্রীষ্মের দহনজ্বালার কথা।

Advertisement

শুধু অধ্যাত্মবিদ্যাই নয়, সাধারণ মানুষ যাতে নানা লৌকিক ও ব্যবহারিক পরিস্থিতি উপযুক্ত ভাবে মোকাবিলা করতে পারে, সেই পরামর্শ একই ভাবে প্রাচীন মুনি-ঋষিরা দিয়ে গিয়েছেন। ব্রহ্মাণ্ড যখন আক্ষরিক অর্থেই পুড়ছে, তখন নাগরিক জীবনে নিরন্তর শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের ঘেরাটোপে বসে রেহাই পাওয়া যাবে না। প্রকৃতি যাতে আমাদের প্রতি সদয় থাকে, প্রকৃতির আশ্রয়ের নিশ্চিন্ততার বোধ যেন আমাদের মধ্যে আবার জেগে ওঠে, সেই হুঁশ ফেরানো জরুরি।

তথাগত বুদ্ধের ব্যক্তিগত চিকিৎসক জীবকের শিক্ষাগুরু ছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদ ও দর্শনের অধ্যাপক ভিক্ষু আত্রেয়। তিনি এবং সমকালীন মনীষীরা ছ’টি ঋতুর কথা উল্লেখ করেছেন— শিশির, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত। এর মধ্যে প্রথম তিন ঋতুতে সূর্যের উত্তরায়ণ। আয়ুর্বেদাচার্যেরা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শরীর সুস্থ রাখার নানা উপায় বাতলে দিয়েছেন।

আয়ুর্বেদাচার্যেরা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শরীর সুস্থ রাখার নানা উপায় বাতলে দিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত।

আয়ুর্বেদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘অষ্টাঙ্গ-হৃদয়-সংহিতা’ রচয়িতা বাগভট চমৎকার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, গ্রীষ্মকালে সূর্য ‘অতিতীক্ষ্ণাংশু’ হয়ে জগতের যাবতীয় রস শুষে নেয়। উত্তরায়ণের এই সময়টাতে সূর্য ও বাতাস হয়ে ওঠে অত্যন্ত রুক্ষ। ঋষিরাও তাই এই আবহাওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, প্রকৃতির সৌম্যগুণের হানি ও রুক্ষ রসের বৃদ্ধি হয় বলে এই কাল ‘আগ্নেয়’। শরীর এই সময় দুর্বল হয়। ঋতু অনুযায়ী আদর্শ খাদ্য-পানীয় গ্রহণের সন্ধান রয়েছে ‘অষ্টাঙ্গ-হৃদয়-সংহিতা’র এই শ্লোকটিতে—

‘শীতে বর্ষাসু সাদ্যাংস্ত্রীন্ বসন্তেঽন্ত্যান্ রসান্ ভজেৎ।

স্বাদুং নিদাঘে, শরদি স্বাদুতিক্তকষায়কান্।।

শরদ্ বসন্তয়োঃ রুক্ষ শীতঘর্মঘনান্তয়োঃ।

অন্নপানং সমাসেন বিপরীতমতোঽন্যথা।।’

অর্থাৎ ‘শিশির’ বা শীতকালের আহারে থাকবে মিষ্ট, অম্ল ও লবনাক্ত দ্রব্য, বসন্তে সুরা, গ্রীষ্মে থাকবে সহজপাচ্য, লঘু, স্নেহপদার্থ যুক্ত খাবার এবং মধু। শরতে তিক্ত, মিষ্ট এবং কষায়। তীব্র গরমে শরীর ঠান্ডা রাখতে বাগভট বলেছেন, সুশীতল জলে স্নান করে মিষ্টি দিয়ে ছাতুর শরবত খেতে। তবে এটি কিন্তু প্রচলিত ছোলার ছাতু নয়। বৈদিক যুগ থেকে আমাদের আদি শস্য যব। পরবর্তী কালে সাংবাদিক ও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার প্রশস্তি গেয়ে লিখেছিলেন, ‘এ যব দোষের নয়, গুণের কেবল। / মেহ-পিত্ত-কফ হবে মধুর শীতল।।’

গ্রীষ্মের শুরুতে চৈত্র সংক্রান্তিতে ‘ভাই ছাতু’ উদ্‌যাপনের রীতি ছিল। প্রকৃতির ছন্দে তাল মিলিয়ে প্রাত্যহিক জীবনচর্যাতেও নানা উপকারী খাবার, ফলমূল, শাক-সব্জি, সবই এমন সব পারিবারিক লোকাচারের মাধ্যমেও স্বাভাবিক নিয়মে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠত। যবের ছাতু দই, কলা, লবণ ও চিনি দিয়ে মেখে ঠান্ডা জল ঢেলে পাতলা করে সকালের জলখাবারে এক বাটি খেলেই তো দেহ-মন জুড়িয়ে যায়। কিংবা সাবুমাখা? ছোট দানার সাবু সারা রাত ভিজিয়ে পর দিন সকালে কলা, নারকেল কোরা, লবণ, চিনি, কাঁচালঙ্কা ও লেবু দিয়ে মেখে ঠান্ডা জলে পাতলা করে নিয়ে খেলে, জলখাবারে চমৎকার। এমন সব ঘরোয়া খাবারের রীতি কি হারিয়েই যাবে? স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, পুরনো কলকাতায় সকালে আদা-ছোলা, ভেজানো মুগ, মুড়ি-মুড়কি আর বিকেলে ফল খাওয়ার চল ছিল।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে প্রকৃতি সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রচার করা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত।

বাগভট বলছেন, গরমে মদ্যপান হানিকর। মদ্যপান করলেও তা করতে হবে অতি অল্প পরিমাণে অনেকটা জল মিশিয়ে। সুরাপান ছাড়া একটি উপকারী শরবতের কথা তিনি শুনিয়েছেন। পাকা কলা, কাঁঠালের কোয়া আর একটু লেবু বা তেঁতুল দিয়ে শরবত বানিয়ে খেলে শরীর ঠান্ডা হবে। এ ছাড়া একটু পারুল ফুল আর কর্পূর দিয়ে সুবাসিত জল পান করলেও খুব তৃপ্তি হবে। তবে যাঁরা ভাবছেন, এই গরমে মাংস খেলে শরীর আরও তপ্ত হবে বলে মাংস না খাওয়াই ভালো, তাঁদের আশ্বস্ত করে রাজা নল স্পষ্ট বলেছেন, গ্রীষ্মে ভেড়ার মাংসের পাতলা ঝোল খুবই উপকারী—

‘অবিকঞ্চ পলং মেষমামিষং শীতলং মৃদুঃ।

গ্রীষ্মর্তৌ তু পরং পথ্যমুঞ্চকারণকং হিতম।’

দুপুরে যদি মাংস-ভাত হয় তা হলে রাতের খাবার কেমন হবে? তার নির্দেশও রয়েছে। সেই বর্ণনা বড়ই রোম্যান্টিক। এই গরমে যে বিবরণ শুধু পড়লেও মন স্নিগ্ধ হয়ে যায়। রাতে হালকা খাবার খাওয়ার পর পান করতে হবে জ্যোৎস্না ও নক্ষত্র কিরণে শীতল মোষের দুধ।

ঋতুবৈচিত্রে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে প্রকৃতিকে লালন করে অতীতের মানুষ কী মনোরম ভাবে জীবন কাটাতে জানত তার সুন্দর ছবি আমরা পাই এই সব সংস্কৃত সাহিত্যে। গ্রীষ্মের তীব্র দহন থেকে বাঁচার উপায় বার করতে মানুষ আশ্রয় নিত কোনও উপবনে। প্রকৃতিকে নিঃশেষ করে সেখানে ছিল না আকাশচুম্বী অট্টালিকার দর্পিত অহঙ্কার। বরং মধ্যাহ্নের সূর্যরশ্মি এবং খরতাপ থেকে সকলকে রক্ষা করার জন্য ছিল সুবিশাল শাল ও তাল গাছের শ্যামল আচ্ছাদন। সেখানে আঙুরলতা আর মাধবীলতায় মিতালি। সেখানে বাঁশের তৈরি কুটির ঘিরে থাকত আম-জাম ফলমূলের গাছের ছায়া, শীতল, সুগন্ধি বারিধারার রচিত আবরণ। মৃন্ময় কুটিরের ভিতরে শয্যাটি সুন্দর করে সাজানো হত কোমল কলাপাতা, লালপদ্ম, শ্বেতপদ্ম আর শালুক ফুলে। কুটির সংলগ্ন ফোয়ারাটিতে কাঠের তৈরি নারীমূর্তি। সেই মূর্তির সুডৌল স্তনযুগল, হাত ও মুখ থেকে ঝরে পড়ছে খসখস-সুবাসিত জলধারা। সেই কুটিরে নিদাঘ বেলায় সুখনিদ্রার এই হল স্বর্গীয় আয়োজন। রাতের বর্ণনাও কম রমণীয় নয়। চন্দ্রকিরণে স্নিগ্ধ গৃহে প্রবেশ করতে হবে শরীরে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে। পরনে পাতলা কাপড়। কণ্ঠে ফুলমালা। রতিক্রিয়ার চিন্তা পরিত্যাগ করে থাকতে হবে শান্ত চিত্তে। জলসিক্ত বস্ত্র যুক্ত পদ্মপত্রের আকৃতির চামরের জলকণাবর্ষী শীতল বাতাসে দূর হবে যাবতীয় ক্লান্তি।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে প্রকৃতি সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রচার করা হয়েছিল। ধরিত্রী দিবসের সূচনা তো মাত্র ১৯৭৪ সালে। কিন্তু তার বহুকাল আগে, ভারতের সংস্কৃত গ্রন্থ ‘পদ্মপুরাণে’ (৫৬-৪০-৪১) বলা আছে, গাছ কাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ আর গাছ কাটলে বা তৃণভূমি ধ্বংস করলে ভবিতব্য নরকবাস। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তো একেবারে নির্দিষ্ট জরিমানা ধার্য করা আছে। নগরের উপান্তের কোনও উদ্যানে কেউ যদি কোনও ফলের গাছ বা ছায়াদানকারী বৃক্ষের চারা নষ্ট করে তাকে জরিমানা হিসেবে দিতে হবে ছ’টি ‘পনস’ বা কাঁঠাল। সেই গাছের কচি ডালপালা ভাঙলে জরিমানা হবে এক ডজন কাঁঠাল। বড় শাখা-প্রশাখা ধ্বংস করলে জরিমানা একলাফে বেড়ে হবে দু’ডজন কাঁঠাল। আর সেই গাছের গুঁড়ি কাটলে বা পুরো গাছ ধ্বংস করলে সোজা আদালতের বিচার। সনাতন হিন্দু ধর্মে বৃক্ষ ও প্রকৃতি বন্দনার প্রশস্তির প্রকৃত লক্ষ্য হল, মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গাছ রক্ষা করা তাঁদের আবশ্যিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন। আর সে কারণেই প্রতিটি গাছের প্রতি তাঁরা আরোপ করতেন ধর্মীয় পবিত্রতা। তাই সমাজে খুব সহজেই গাছ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় আরাধনার বস্তু। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে লোকাচারেও। অসমের কাছাড় অঞ্চলে মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল এমনই এক সামাজিক রীতি— ‘রূপসী ব্রত’। ‘বারোমাসি গানে’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাঙালি হিন্দু রমণীরা সন্তান জন্মের পর নবজাতককে বাড়ির কাছের কোনও গাছের পদমূলে রেখে মনে মনে প্রার্থনা করতেন, ‘হে বৃক্ষ, তুমি যদি আমার সন্তানকে রক্ষা করো, তা হলে আমিও তোমাকে রক্ষা করব।’ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তেও কোনও একটি বিশাল গাছকে ‘ভৈরব বৃক্ষ’ হিসেবে গ্রামের রক্ষাকর্তা বলে মান্য করার সামাজিক রীতি আছে। মনে করা হয়, রোগ-শোক-বিপদ-আপদ-প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সেই গ্রাম ও তার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে ওই মহীরুহ। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমায় মহাভারত রচয়িতা কাশীরাম দাসের ভিটেবাড়ি সিঙ্গি গ্রামে রয়েছে এমনই এক ভৈরব বৃক্ষ। কয়েক শত বছরের প্রাচীন বটগাছটি যেখানে বহু শাখা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটি ক্ষেত্রপালতলা নামে পরিচিত। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখায় জানা যায়, ১৮৮০-৮১ সালে তিনি সিঙ্গিতে ‘বড় জাগ্রত ক্ষেত্রপাল ঠাকুরের স্থান’ দেখেছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস, ওই গাছের একটি পাতা ছিঁড়লেও শাস্তি অনিবার্য। স্থানীয় মানুষ যাবতীয় শুভ কাজে ক্ষেত্রপাল ঠাকুরকে পুজো দিয়ে থাকেন। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে বিরাট মেলায় কয়েক লাখ লোকের সমাগম হয়। লৌকিক আচারের মাধ্যমে বৃক্ষ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।

মানুষ যে নির্মম ভাবে সীমাহীন লোভে পরিবেশের স্বাভাবিক ছন্দকে ধ্বংস করেছে, সেকথা আজ সকলে মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং গ্রীষ্মের এই দাপট সেই প্রকৃতি ধ্বংসেরই পরিণতি। বছরের বিশেষ একটি দিনে আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণের রীতির প্রতি মর্যাদা প্রকাশ করেও, স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক যে এর বহু আগে ‘বনমহোৎসবে’র উল্লেখ রয়েছে বরাহপুরাণে। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সমাজের কল্যাণের সঙ্গে বনস্পতির ওতপ্রোত সংযোগের মহিমা প্রচারিত হয়েছে। অরণ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে চরকসংহিতার ‘বিমানস্থানমে’ (৩-১১) স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে, গাছ কাটলে, নির্বিচারে বন সাফ করলে তা বিরাট বিপদ ডেকে আনবে। পরিবেশ দূষণ ও বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। গাছ কাটা ছিল রীতিমতো অপরাধ। একদা গ্রামাঞ্চলে লৌকিক বিশ্বাস ছিল, শ্যাওড়া গাছে ভূত থাকে। কোনও গাছে ব্রহ্মদৈত্য। সে সব গাছ কাটতে নেই। তেমনই আবার কোনও কোনও গাছের সঙ্গে ছিল দৈব সংযোগ। সুতরাং সেই গাছ কাটা পাপ। অরণ্য সংরক্ষণে সেই সব প্রচলিত বিশ্বাসের ভূমিকাও কিন্তু কম ছিল না।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সমাজের কল্যাণের সঙ্গে বনস্পতির ওতপ্রোত সংযোগের মহিমা প্রচারিত হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

প্রকৃতি ও মানুষের ছন্দোবদ্ধ সহাবস্থানই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সুর। বেদ, উপনিষদ, স্মৃতি, ধর্মশাস্ত্রে ধরিত্রীকে নানা ভাবে মাতৃরূপে বন্দনা করার কথা বলা হয়েছে। বৈদিক দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সেকালের ধর্মচর্চা বা লোকাচারের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় নীতিবোধ তখনকার সমাজে সহজেই গড়ে উঠেছিল। ‘নমলিঙ্গানুশাসন’ বা বহুল পরিচিত ‘অমরকোষ’-এ বিভিন্ন গাছের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য চমৎকার ভাবে বোঝানো হয়েছে। পাশ্চাত্যের ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে এর স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করার মতো। ‘অমরকোষ’-এ বৃক্ষ, মহীরুহ, শাখী, পাদপ, তরু, অগম প্রভৃতির পৃথক সংজ্ঞা নিরুপণ করা হয়েছে। আবার চরক বলেছেন, ফলদায়ী গাছ হল বনস্পতি, যে গাছে ফুল ও ফল দুই-ই হয় তা হল বনস্পত্য। বরাহপুরাণের (১৭২-৩৯) উপদেশ অনুযায়ী নিম, পিপুল, বট, নানা রকম পুষ্পবৃক্ষ বা লতা, ডালিম, কমলা ও আম গাছ রোপন করলে তা হবে সমাজ ও পরিবেশের পক্ষে কল্যাণকর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো পশ্চিমের উন্নত দেশগুলিতে কিন্তু ইতিমধ্যেই টনক নড়েছে। অর্থোপার্জন ও কর্মব্যস্ততায় সেখানকার মানুষ এত দিন ধরে প্রক্রিয়াজাত খাবার আর বাইরের খাবার খেয়ে মহানন্দে দিন কাটিয়েছে। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই বোঝা যাচ্ছে, লাইফস্টাইল ডিজ়িজ়— জীবনশৈলী জনিত রোগভোগ কী ভাবে বেড়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের প্রভাবে আমাদের দেশেও ইটিং আউট, প্রক্রিয়াজাত খাবার এখন রমরম করে চলছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগ আর আধুনিক চিকিৎসার খরচ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চার বছর আগেই স্বাস্থ্যকর খাবারের পরামর্শ জারি করে বলেছে, হার্টের রোগ, স্ট্রোক এবং ক্যানসারের ঝুঁকি প্রতিরোধে প্রতিদিন প্রত্যেকের অন্তত চারশো গ্রাম করে টাটকা ফলমূল ও শাকসব্জি খাওয়া জরুরি। তারপর থেকেই পাশ্চাত্যে ‘ফাইভ আ ডে’ অর্থাৎ পাঁচ রকমের নানা রঙের সব্জি ও ফল বা ‘থার্টি প্ল্যান্টস আ উইক’ অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে খাবারের মেনুতে বেগুন, ব্রকোলি, গাজর, পালং, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, টোম্যাটো, শিম, বরবটি-সহ বিভিন্ন ধরনের শাকসব্জি, ফল, অঙ্কুরিত ছোলা, মুগ বা মটর, নানা রকম ডাল ও মশলাপাতি ইত্যাদি রাখার প্রচার চলছে। উদ্দেশ্য, কর্মব্যস্ত মানুষকে প্রক্রিয়াজাত খাবারের গোলকধাঁধা থেকে বার করে এনে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক খাবারের প্রতি নতুন করে আকৃষ্ট করা। সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমাদের দেশে মল-সংস্কৃতি বিপুল ভাবে থাবা বসালেও এখনও আমরা চারপাশে টাটকা ফলমূল, সব্জি পাচ্ছি। কৃত্রিম, রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট করা খাবারের কুফল উপলব্ধি করে আমরা যদি চারপাশের প্রকৃতি আর ধ্বংস হতে না দিই, রাসায়নিক সার, কীটনাশক যুক্ত খাবারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে যদি দেশজ বীজ থেকে উৎপন্ন জৈব ফসলকে মর্যাদা দিই, বিষমুক্ত খাবারের চাহিদা যদি বাড়িয়ে তুলতে পারি, তা হলে হয়তো সমূহ সর্বনাশ এড়ানো যাবে।

প্রকৃতি ও মানুষের ছন্দোবদ্ধ সহাবস্থানই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সুর। ছবি: সংগৃহীত।

এই গরমে নিজের শরীর বাঁচাতে এবং পরিবারের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এই ‘মাইন্ডফুল ইটিং’ শুরু করা যেতেই পারে তরমুজের শরবত কিংবা বেলের পানার মতো আমাদের একান্ত ঘরোয়া সাধারণ খাবারদাবার দিয়ে। সাধারণ ফলমূল, শাকপাতার গুণাগুণ এখন রীতিমতো গবেষণার বিষয়। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি শিক্ষার হিড়িকে ভারতের জ্ঞানের অসীম ভান্ডার অবহেলিত হল। মজার ব্যাপার, সেটা হল সেই বেদ, উপনিষদ, পুরাণ চর্চার কেন্দ্রে। বেলের পানা খেতে গিয়ে তাই বেলের মাহাত্ম্য বিস্মৃত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। স্কন্দপুরাণে আছে দেবী পার্বতীর কপালের ঘাম থেকে একটি স্বেদবিন্দু পড়েছিল মন্দার পর্বতের উর্বর ভূমিতে। মহামায়ার সেই ঘর্মবিন্দু থেকেই উৎপত্তি বিল্ব বৃক্ষের। এই গাছে পার্বতী তাঁর বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত বলে মহাদেব শিব বিল্বপত্রের প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী। পূজাপার্বণে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ত্রিপত্র বেলপাতা অপরিহার্য। আবার বেলপাতার শীতল প্রভাবের প্রশস্তিও রয়েছে পুরাণে। সেখানে বলা হয়েছে, যে সব দেবতা মুহূর্তে রুষ্ট হয়ে ওঠেন, বদমেজাজি, তাঁদের তুষ্ট ও শীতল করতে বেলপাতা নিবেদনের জুড়ি নেই। ইউটিউব খুললে দেখা যাবে, বেলপাতার শরবতও ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক হাইপারটেনশনের রোগী বেলপাতা ভেজানো জলও পান করেন। আবার ফল হিসেবেও বেল অমৃত। সেটি পরিচিত শ্রীফল নামে। চ্যবনপ্রাশের অন্যতম উপাদান। কচি বেলের মোরব্বা যেমন কোষ্ঠকাঠিন্যে উপকারী, তেমনই পাকা বেল ডায়েরিয়া ঠেকাতে অব্যর্থ। আরও কত গুণ! ক্যান্সার প্রতিরোধক, তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে গ্লুকোজ়, প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন। ওড়িশায় আবার বেলের শাঁসের সঙ্গে লেবুর রস, গোলমরিচ গুঁড়ো, পুদিনা আর বরফজল দিয়ে চমৎকার একরকম শরবত হয়। মহাবিষুব সংক্রান্তি বা ওড়িয়া নববর্ষে খুবই জনপ্রিয় বেল, ছানা, গুড়, কলা ও ডালিমের দানা মিশিয়ে তৈরি শরবত। ইন্দোনেশিয়ার মানুষ বেলগাছের মূল ও পাতা দিয়ে দিব্যি তরকারি রেঁধে খান। সাধে কি আর শঙ্করাচার্য বলেছেন —

‘দংতিকোটি সহস্রেষু অশ্বমেধ শতানি চ।

কোটিকন্যাপ্রদানেন একবিল্বং শিবার্পিতম্॥’

এক হাজার হাতি দান করলে অথবা এক শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে কিংবা কোটি কন্যার বিবাহ দেওয়ার সমষ্টিগত পুণ্য সঞ্চয় সম্ভব শিবকে একটি বেলপাতা অর্পণ করলেই। অর্থাৎ, আমরা এ কথা বলতেই পারি, বৃক্ষনিধনের কুফল যদি আমরা কিছুমাত্র উপলব্ধি করে থাকি, তা হলে অন্যান্য গাছের সঙ্গে বেলগাছ রোপণ করলেও প্রকৃতির ও মানুষের উপকার। আবার তরমুজেরও তুলনা নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় এর উৎপত্তি হলেও প্রবল গরমের দেশ মিশরের ইতিহাসেও রয়েছে তরমুজের উপস্থিতি। ফলটির শতকরা ৯২ ভাগই জল। কাজেই তীব্র দহনে তরমুজ খেলে শরীরে জলশূন্যতার আশঙ্কা এড়ানো যায়। ফারাওয়ের সমাধিক্ষেত্র পিরামিডের চিত্রে তরমুজের চিহ্ন ফলটির গুরুত্বের কথা তুলে ধরে। শরীর শীতল করতে তেঁতুলের ক্কাথ অম্বলেরও জুড়ি নেই। কাঁচা তেঁতুল সিদ্ধ করে বা নতুন পাকা তেঁতুল জলে ভিজিয়ে হাতে চটকে ক্কাথ বার করে ঠান্ডা জল মিশিয়ে নিতে হবে। তাতে দিতে হবে স্বাদ মতো আখের গুড়, সুগন্ধের জন্য কাঁচা লঙ্কা, একটু লবণ আর গন্ধরাজ লেবুর রস ও ছিঁড়ে টুকরো করা লেবুপাতা। বড় কাচের বা পাথরের গেলাসে ঢেলে পান করলেই অমৃত।

বেদ, উপনিষদ, স্মৃতি, ধর্মশাস্ত্রে ধরিত্রীকে নানা ভাবে মাতৃরূপে বন্দনা করার কথা বলা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

প্রকৃতির বৈচিত্রের সঙ্গে মানুষের শরীর-মনকে কী ভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, সে ব্যাপারে সপ্তম শতকের আয়ুর্বেদাচার্য মাধবকর মাত্র একুশটি শ্লোকে যে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন সেটির নাম ‘কূটমুদ্গর’। লোহার মুগুর দিয়ে যেমন কঠিন বস্তু গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, তেমনই আয়ুর্বেদের কঠিন স্বাস্থ্যবিধি ও চিকিৎসাবিধি মেনে চললে রোগের রূপ-ধারী যে কোনও শত্রুকেও নিকেশ করা যায়। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় প্রাচ্যের এই সব জ্ঞানের সুফলটুকু ছেঁকে নিতে ব্যাপক গবেষণা চলছে। প্রকৃতির বার্তা বুঝে নেওয়ার দৌড়ে আমরা কি পিছিয়ে থাকব?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement