অ্যান্টিবায়োটিক থেকে কী বিপদ ঘনাচ্ছে? প্রতীকী ছবি।
দু’দিনের জ্বর সারাতে দোকান থেকে চেনা অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে ফেলেন অনেকেই। পেটের অসুখ হলেই যথেচ্ছ ব্যবহার হয় জনপ্রিয় মেট্রোনিডাজ়োল গোত্রের ওষুধ। এ ভাবেই কি সাধারণ অসুখবিসুখের সঙ্গে লড়তে কড়া ডোজ়ের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর? শুধু নিজেই খাচ্ছেন না, বাড়ির শিশু ও বয়স্কদের চিকিৎসাও অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ়ে সেরে ফেলছেন নিজেই।
পছন্দের বড়ি নিরাপদ মনে করে যথেচ্ছ খেয়ে ফেলার এই অভ্যাসই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। যে অ্যান্টিবায়োটিকের রোগ সারানোর কথা ছিল, তা-ই ক্রমশ প্রতিরোধী করে তুলছে শরীরকে। আর এর দৌলতেই এক শ্রেণির জীবাণু ক্রমশই অপরাজেয় হয়ে উঠছে। অ্যান্টিবায়োটিক আর তাদের বধ করতে পারছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িস্ট্যান্স’ বা ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজ়িস্ট্যান্স’। সম্প্রতি ‘দ্য ল্যানসেট’-এর গবেষণাতেও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের কথা উঠে এসেছে। গবেষকেরা বিশ্বের ২০৪টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দাবি করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের কারণেই প্রায় ৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি।
এই বিষয়ে মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, “প্রতি বছর শুধুমাত্র ভারতেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে মৃত্যু হয় অনেক শিশুর। সচেতন না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এমন সময় আসবে, যখন বেশ কিছু চেনা অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না শরীরে। অসুখ প্রতিরোধী অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যক্ষমতা হারাবে। শক্তিশালী হয়ে উঠবে জীবাণুরা।”
অ্যান্টিবায়োটি প্রতিরোধী সংক্রমণ কী?
চিকিৎসকের কথায়, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শরীরে যাওয়ার পর তার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা লাভ করে বেশ কিছু ব্যাক্টেরিয়া, পরজীবী। ফলে নির্দিষ্ট অসুখ প্রতিরোধে যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, একটা সময়ের পর তা আর কাজ করে না। এর বিকল্পও তেমন কিছু না থাকায়, ধীরে ধীরে মৃত্যু ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
সে না হয় হল। কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক যা ঘটছে তা হল এই যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী কিছু জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে, যাদের বলা হয় ‘সুপারবাগ’। এমনটাই জানিয়েছেন চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। তাঁর মতে, আগামী দিনে বিশ্ব জুড়ে নতুন মহামারির কারণ হতে পারে এই সব সুপারবাগ। এদের ঘায়েল করার কৌশল তেমন ভাবে জানা নেই। তবে গবেষণা চলছে। এই সুপারবাগেরা এমন ধরনের জীবাণু, যারা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে সহজেই।
কী ভাবে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ধরা যাক, জ্বর হল। জ্বরের জন্য নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিক খেতে শুরু করলেন। প্রত্যেক অ্যান্টিবায়োটিকেরই নির্দিষ্ট ডোজ় থাকে, যা চিকিৎসক বলে দেন। কিন্তু নিজে থেকে খেলে তা বোঝা যায় না। পাঁচ দিনের ওষুধের কোর্স তিন দিন খেয়েই বন্ধ করে দিলেন। এতে জ্বর সারল ঠিকই, কিন্তু অন্য বিপত্তিও বাধল। জ্বরের জীবাণুরা ঝিমিয়ে গেল, কিন্তু মরল না। উল্টে অ্যান্টিবায়োটিককে চিনে নিয়ে তার প্রতিরোধী সুরক্ষা কবচ বানিয়ে ফেলল। তার পর শরীরের ভিতরেই তারা বংশবিস্তার শুরু করল। নতুন জীবাণুরা কিন্তু সেই অ্যান্টিবায়োটিককে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নিয়েই জন্মাবে। তারাই হয়ে উঠবে সেই সুপারবাগ। তাদের কোষের বাইরে লাইপোপলিস্যাকারাইড বা এলপিএস নামে এক ধরনের আবরণ তৈরি হবে, যা ভেদ করে অ্যান্টিবায়োটিকও প্রভাব খাটাতে পারবে না। ফলে যখন আবার জ্বর হবে ও সেই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকই খাবেন, তখন তা আর শরীরে কাজই করবে না। যখন-তখন গাদা গাদা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতাকেই এর জন্য দায়ী করছেন চিকিৎসক।
খোলা বাজারে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। এর জেরে ওষুধ কেনার জন্য কোনও রকম বিধিনিষেধই নেই। ফলে ইচ্ছা মতো ওষুধ কিনে খাওয়ার উপায় রয়েছে। আর তা-ই বিপদের কারণ হয়ে উঠছে।