গুরুতর শ্বাসকষ্টের লক্ষণ - ২০১৯ সালের শেষ দিকে চিনের হুনান প্রদেশে একটি মারণ ভাইরাস - করোনাভাইরাস ২ (সার্স-কোভ-২) ধরা পড়ে। যার প্রকোপের ফলে মানুষের শরীরে তীব্র শ্বাসকষ্টজনিত রোগ হতে দেখা যায়। কিছু রোগীর শরীরে এই ভাইরাসের চেহারা মারণ আকার ধারণ করে। যার ফলে বহু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। দেখা গিয়েছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মানুষই কোনওরকম অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যা ইঙ্গিত দেয় যে ওই সমস্ত রোগীর দেহে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া এই সংক্রমণ প্রতিরোধ বা নিরাময়ের জন্য যথেষ্ট। আবার অন্যদিকে, যে ২০ শতাংশ রোগীর শরীরে এই ভাইরাসের মারণ রূপ বিস্তার হয়ে ছিল, তাদের ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়াই রোগীর শারীরিক স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে গিয়েছে।
কোভিড ১৯-এর ইমিউনোপ্যাথোজেনেসিস কী?
সার্স-কোভ-২ এর সংক্রমণের পরে ভাইরাস অ্যালভোলার এপিথেলিয়ামের এস২-এর মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। এই সংক্রামিত এপিথেলিয়াল কোষগুলি, ডেনড্রিটিক কোষ, নিউট্রোফিলস এবং মনোসাইটস/ম্যাক্রোফেজ ইত্যাদিকে সংঘবদ্ধ করে। যা সিডি৪+ সিডি৮+টি কোষকে সক্রিয় করে দেয়। এই কোষগুলি অ্যান্টি-ভাইরাল প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে যা ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিকে নির্মূল করে। বাকি ২০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে বেশ কিছু অস্পষ্ট প্রক্রিয়াগুলির কারণে টি সেলের আধিক্য হ্রাস পেতে থাকে। বরং এই ক্ষেত্রে শরীরের মধ্যেই একটি সাইটোকাইন ঝড়ের সৃষ্টি হয়। যার ফলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা যায়, যেমন তীব্র শ্বাসকষ্ট, অনিয়নিত হৃদস্পন্দন, নিম্ন রক্তচাপ ইত্যাদি। হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে পড়া বিভিন্ন ডেনড্রিটিক কোষ এবং মনোসাইটস/ম্যাক্রোফেজের কারণে তৈরি হওয়া আইএল ৬ সহ বিভিন্ন সাইটোকাইনগুলিকে মূলত এই পালমোনারি রোগগুলির কারণ হিসেবে ধরা হয়। সিরাম আইএল ৬-এর ঘনত্বের উপরে এই রোগের তীব্রতা এবং মৃত্যুর হার নির্ভর করে। আইএল ৬-এর পথ বন্ধের ফলে সাইটোকাইন রিলিজ সিনড্রোম (CRS) এবং এআরডিএস রোগীদের উপরে যে চিকিৎসাজনিত প্রভাব পড়ে তা কোভিড-১৯ এর মারাত্বক আকার ধারণ করে।
কী ভাবে আমাদের শরীর করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে?
ভাইরাল ইনফেকশনের পরেই, হোস্ট কোষের ক্ষতি না করে জীবাণু নির্মূল করার জন্য দেহে জন্মগত বা সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা অবিলম্বে সক্রিয় হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়া দেহের অর্জিত অনাক্রম্যতার বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত হোস্টের প্রতিরক্ষার জন্য দায়ী। সংক্রমণের ৭ বা তারও বেশি দিন পরে টি ও বি কোষের প্রতিক্রিয়াগুলি সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় হয়। ভাইরাল শেডিংয়ের সাময়িক গতিশীলতা বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে কোনও রকম লক্ষণ পরিলক্ষিত হওয়ার আগেই গলা থেকে ভাইরাস শেডিংয়ের শুরু হয়ে যায়। এবং তা ধীরে ধীরে হ্রাসও পেতে থাকে। এর ফলে বোঝা যায় যে একটি অ্যান্টি ভাইরাল প্রতিরোধ ক্ষমতা ওই ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির পদ্ধতিকে প্রাথমিক পর্যায়েই দমিয়ে দিয়েছে। ভাইরাস সংক্রমিত কোষগুলির দ্বারা তৈরি হওয়া টাইপ আই ইনটারফেরন (আইএইএন)-এর অভিব্যক্তি সহজেই ভাইরাসের প্রতিলিপিগুলিকে বা বংশবৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। যার ফলে কোভিড ১৯-এর প্রকোপকে কমাতে সাহায্য করে। ৮০ শতাংশ রোগীদের ক্ষেত্রেই ভাইরাস নির্মূল করার মূলে পরবর্তী সময়ে অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে জন্মগত বা সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার যুগলবন্দিই যথেষ্ট। যাঁরা কোনওরকম অ্যান্টি ভাইরাল চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাকি সংক্রমিত রোগীদের দেহে ভাইরাস নির্মূল করার জন্য তা যথেষ্ট নাও হতে পারে।
হার্ড ইমিউনিটি অর্থাৎ গোষ্ঠী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কী ভাবে কাজ করে?
কিছু সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ যা একে অপরের থেকে ছড়িয়ে পড়ে, তা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে যদি ওই সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। বলা হয়, যদি কোনও জনগোষ্ঠীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ সংক্রমণ অথবা বাহ্যিক টিকাকরণের মাধ্যমে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, তবে তা হার্ড ইমিউনিটি হিসেবে গণ্য় করা হবে। তবেই সংক্রমণের এই শিকলে দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটে ভাঙন ধরতে পারে। যদিও কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রে হার্ড ইউনিউনিটি অর্জন করা বেশ মুশকিল। কারণ এর ঘন ঘন চরিত্র বদলের ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে।
কোভিড ১৯ সম্পর্কে বাজার চলতি গুজব এবং সত্যতা
১. গরম জল পান করা বা ভাপ নেওয়া
গুজব: গরম জল পান করলে বা ভাপ নিলে, গলা থেকে করোনা ভাইরাস একেবারে নির্মুল হয়ে যায়।
বাস্তব: জল আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিজ্ঞান কখনই এ কথা বলে না যে, গরম জল পান বা ভাপ নেওয়া আপনাকে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এটি একমাত্র আপনার গলাকে প্রশমিত করতে পারে এবং আপনি যদি সত্যিই অসুস্থ থাকেন তা হলে গলা থেকে কফ তুলতেও সাহায্য করে।
২. সাপ্লিমেন্টস
গুজব: ভিটামিন এবং মিনারেল সাপ্লিমেন্টস করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রোগীকে সারিয়ে তোলে।
বাস্তব: ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি এবং মিনেরাল জিঙ্ক আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে যাঁদের শরীরে এগুলির ঘাটতি রয়েছে, এটি কেবল মাত্র তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু এই ওষুধগুলি খেলে যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তেমন কোনও তথ্য এখনও পর্যন্ত নেই।
৩. পুনরায় কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ
গুজব: আমার একবার করোনা হয়ে গিয়েছে, অথবা আমি করোনার টিকা নিয়েছি, তাই আমি সংক্রমিত হব না।
বাস্তব: বৈজ্ঞানিকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, আমাদের শরীরে একাধিক বার করোনা ভাইরাসের বাসা বাঁধার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বর্তমানে তাঁরা এখনও পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন যে, কী কী ভাবে আপনি আবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, কত বার এই সংক্রমণ ঘটতে পারে, এবং কাদের দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি মাত্রায় রয়েছে। আপনি যদি ইতিমধ্যেই করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকেন, অথবা আপনার যদি টিকাকরণ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলেও আপনার উচিত জনসমক্ষে মাস্ক ব্যবহার করা, ভিড় এড়িয়ে চলা এবং সর্বদা হাত ধোয়া।
৪. কোভিড ১৯ টিকা কতটা নিরাপদ
গুজব: করেনা ভাইরাসের টিকা নিরাপদ নয়, কারণ ঔষধ কোম্পানিগুলি এগুলি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি তৈরি করেছেন।
বাস্তব: যেহেতু গোটা বিশ্ব এক চরম মহামারির মধ্যে দিয়ে দিন জীবন যাপন করছে, তাই ওষুধ কোম্পানিগুলি করোনার টিকা তৈরির জন্য তাদের অধিকাংশ সময় এবং অর্থ ব্যয় করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে করোনার টিকা নিরাপদ নয়। সমস্ত টিকাই একটি কঠোর গবেষণার মাধ্যমে তৈরি হয় যাতে তা নিরাপদ থাকে এবং প্রত্যেকের শরীরে সঠিক কাজ করে। এমনকি WHO, USFDA, DCGI ইত্যাদি নিয়ন্ত্রক কোম্পানিগুলি সর্বপ্রথম এই টিকাগুলিকে অনুমোদন করে, তারপর এগুলি জনসাধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৫. কোভিড ১৯ টিকা নেওয়ার পর অসুস্থতা
গুজব: করোনার টিকা নিলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব।
বাস্তব: এ কথা একেবারেই সত্য না। অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলিতে কখনই কোনও জীবিত ভাইরাস থাকে না।