ভারতের জন্য কি এই খাদ্য পিরামিড স্বাস্থ্যকর? ছবি: সংগৃহীত।
খাদ্য পিরামিডের উলটপুরাণ! মানবজাতির খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের যাবতীয় খুঁটিনাটি বদলে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্বের ২৪ জন চিকিৎসক। ধরে নিন, এমন এক নতুন খাদ্য পিরামিড তৈরি হল, যেখানে ঘি, পনির এবং মুরগির মাংস নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকায় রয়েছে এবং আর ভাত এবং রুটির দেখাই মিলছে না। অবাক হচ্ছেন তো? পুরনো অভ্যাস পুরোপুরি ত্যাগ করে নতুন খাদ্যাভ্যাসের যুগ শুরু হয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে ২৪ জন চিকিৎসক এবং গবেষক মিলে একটি নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন পিয়ার-রিভিউ জার্নাল ‘নিউট্রিয়েন্টস’-এ। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এই পিরামিডটি নিছক তত্ত্ব নয়, বরং কয়েক দশকের গবেষণার ফল এবং ক্লিনিক্যাল অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ভারতের চিকিৎসকদের মতে, সমাজমাধ্যম বা বিনোদনী জগতের তারকাদের প্রচার করা ‘ট্রেন্ড’ নয় এটি। বরং, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
লো-কার্ব ডায়েট কী ভাবে সাহায্য করবে মানুষকে?
ভাত বা রুটি ছাড়া ডায়েট। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নতুন লো-কার্ব খাদ্য পিরামিডটি ডায়াবিটিসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম। ওজনও কমাতে পারে। টাইপ-২ ডায়াবিটিস, ওবেসিটির সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ চলছে মানুষের। ভারতীয়দের মধ্যেও এ সবে আক্রন্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের জন্য খাবারের ধরন পাল্টানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। লো-কার্ব ডায়েট মানে সারা দিন ধরে মাংস খাওয়া নয়। গবেষকেরা বলছেন, এটি একটি পুষ্টিকর খাবারের পদ্ধতি, যা একাধিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে তৈরি। এই পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যের ভোলবদল হবে বলে বিশ্বাস গবেষক এবং চিকিৎসকদের। এই প্রথম বার গবেষকেরা কল্পনা করেছেন, স্বাস্থ্যকর লো-কার্ব খাবারের থালা কেমন দেখতে হতে পারে।
নতুন খাদ্য পিরামিডের গঠন। ছবি: সংগৃহীত।
নতুন খাদ্য পিরামিডের গঠনটি কেমন?
সবচেয়ে বেশি খেতে হবে (পিরামিডের সবচেয়ে নীচের স্তর): পুরো ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, চিজ়, পনির, টক দই, প্রাণিজ প্রোটিন, রেড মিট, পোল্ট্রির হাঁস-মুরগির ডিম, মাছ এবং শেলফিশ, চর্বি ও তেল, জলপাইয়ের তেল (অলিভ অয়েল), মাখন, ক্রিম।
নিয়মিত খেতে হবে (পিরামিডের মাঝারি স্তর): লো-কার্ব ফল ও শাকসব্জি, সবুজ শাকসবজি (যেমন, পালং শাক, কেল, লেটুস), স্টার্চ বিহীন সব্জি (যেমন, ফুলকপি, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, টম্যাটো), পাতিলেবু, কমলালেবু, জলপাই, অ্যাভোকাডো।
মাঝে মাঝে খেতে হবে (পিরামিডের উপরের স্তর): বাদাম, আখরোট, সূর্যমুখীর বীজ, অন্যান্য বাদাম এবং বীজ, কম চিনিযুক্ত ফল, বেরি (স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি), তরমুজ, স্টার্চ যুক্ত সব্জি, স্কোয়াশ, আলু, পেঁয়াজ।
কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে: রুটি, পাউরুটি, পাস্তা, ভুট্টা, চিনি, মটরশুঁটি এবং শিম জাতীয় খাবার, ভাত, উচ্চ চিনিযুক্ত ফল (যেমন, কলা, আম, আঙুর)। অর্থাৎ পিরামিডে স্থান পেল না ভাত, গমের রুটি, চিনি, মিষ্টি ফল, রস এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলি।
ভারতের জন্য কি এই পিরামিড স্বাস্থ্যকর?
ভারত বিশ্বের ‘ডায়াবিটিস রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত। টাইপ ২ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত ১০ কোটিরও বেশি মানুষ এবং প্রি-ডায়াবিটিসে আক্রান্ত আরও লক্ষাধিক। আর তাই খাদ্যাভ্যাসে বদল আনা দরকার বলে মনে করছেন গবেষকেরা। ডায়াবিটিস চিকিৎসক ভি মোহন জানাচ্ছেন, আইসিএমআর-এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট বেশি। এবং উচ্চ-কার্বযুক্ত খাবার ভারতে ডায়াবিটিস এবং ওবেসিটির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য খানিক পরিমাণে দায়ী। ওজন কমানোর পাশাপাশি ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে এই লো-কার্ব ডায়েট খুবই কার্যকর বলে মনে করছেন চিকিৎসক। যাতে কার্ব কম, কিন্তু প্রোটিন বা ফ্যাট বেশি থাকবে।
তবে, এই ডায়েট কি কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াবে?
অনেক ভারতীয় চিকিৎসক এবং রোগীর আশঙ্কা, এত বেশি ফ্যাট খাওয়ার ফলে ধমনী সরু হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তার ফলে হৃদ্রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু গবেষণাপত্রে ৪১টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য দিয়ে সেই ধারণা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গবেষণাপত্রে লেখা হয়েছে, ‘কিছু ব্যক্তির মধ্যে এলডিএল কোলেস্টেরল বাড়তে পারে, কিন্তু কম কার্বযুক্ত খাবার খেলে হৃদ্রোগের ঝুঁকির ২০টি কারণের মধ্যে ১৭টি কারণ দূর হয়।’ গবেষণার সহ-লেখক ক্যাথরিন শানাহানের কথায়, ‘‘কম কার্বযুক্ত খাবার হৃদ্রোগের কারণ নয়। বরং সেগুলি ঝুঁকি কমায়।’’