কম ঘুমোলে তার ফল মারাত্মক হতে পারে? ছবি: সংগৃহীত।
ক্যানসার রোগটি নতুন নয়। কিন্তু পরিচিত কেউ ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন শুনলেই মাথা থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যেতে থাকে ঠান্ডা স্রোত। অনেকেই হয়তো জানেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং জিনগত কারণেও শরীরে ক্যানসার বাসা বাঁধে। কিন্তু এই ক্যানসারের সঙ্গে যে ঘুমেরও যোগ রয়েছে, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। ইদানীং পেশাগত কারণে বেশির ভাগ মানুষই রাতে টানা ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঘুমোতে পারেন না। রাত জেগে কাজ করতে হয় বলে অনেকেই দিনের বেলা ঘুমিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করেন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ঘুমের এই চরিত্রগত বদল অন্যান্য রোগের পাশাপাশি, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে, বিশ্ব নিদ্রা দিবস ২০২৪ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল বিশেষ একটি আলোচনাসভার। আয়োজক ‘ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি’, কলকাতা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি এবং ক্যালকাটা স্লিপ সোসাইটির সেক্রেটারি চিকিৎসক সৌরভ দাস এবং কলকাতা স্লিপ সোসাইটি-র সভাপতি, কান-নাক-গলার চিকিৎসক উত্তম আগরওয়াল। বিশ্ব নিদ্রা দিবসে এ বছরের থিম ‘স্লিপ ইকুইটি গ্লোবাল হেল্থ’।
দীর্ঘ দিন ধরে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ঠিক কী কী শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে?
হজমের গোলমাল থেকে কাজে অনীহা, অবসাদ, মাথা যন্ত্রণা, মাইগ্রেন, বিপাকহার কমে যাওয়া, সঙ্গে বিপাকহার সংক্রান্ত নানা রোগ, যেমন হরমোনের হেরফের, ডায়াবিটিস, স্থূলত্ব আরও কত কী! কোভিড পরবর্তী সময়ে আরও একটি রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সেটি হল ‘সার্কাডিয়ান রিদ্ম ডিজ়অর্ডার’। মানুষের ঘুম থেকে ওঠা বা ঘুমোতে যাওয়ার যে স্বাভাবিক সময়, তা একেবারে বদলে গিয়েছে। চিকিৎসা পরিভাষায় এই ধরনের সমস্যাকে শিফ্ট ওয়ার্ক ডিজ়অর্ডারও বলা হয়। কিন্তু মারণরোগ ক্যানসার কী ভাবে ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? চিকিৎসক সৌরভ দাস বলেন, “আজ থেকে ২০ বছর আগে যত মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতেন, এখন সেই সংখ্যাটা অনেক বেশি। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার যে ক্যানসারের কারণ, তা সকলেই জানেন। কিন্তু ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আরও একটি কারণ যে অপর্যাপ্ত ঘুম, সে সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা নেই। ঘুম নিয়ে সাধারণ মানুষ বা পেশাদারদের মধ্যে তেমন সচেতনতা এখনও গড়ে ওঠেনি, কিন্তু আজ থেকে দশ বছর পরে অবশ্যই তা স্বাস্থ্যবিধির আওতায় আসবে।”
চিকিৎসক সৌরভ দাস এবং উত্তম আগরওয়াল। —নিজস্ব চিত্র।
অপর্যাপ্ত ঘুম এবং শরীরে তার প্রভাব নিয়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গবেষণা রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে যদি ৬ ঘণ্টার কম সময় ঘুমোন, তা হলে ৬০ শতাংশ পুরুষদের মধ্যে প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্যানসার’-এ সেই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ৫৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন ফুসফুসের ক্যানসারে। অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন ৪০ শতাংশ মানুষ। আবার ক্যানসার এপিডেমিয়োলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম হলে মহিলাদের মধ্যে ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে ৩০ শতাংশ। ৫০ শতাংশের হতে পারে মলাশয়ের ক্যানসার। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া, উচ্চ রক্তচাপ, কোরোনারি হার্ট ডিজ়িজ়, স্ট্রোক, টাইপ ২ ডায়াবিটিস, ইনসুলিন রেজ়িজ়ট্যান্স তো আছেই। চিকিৎসক উত্তম আগরওয়াল বলেন, “শুধু ক্যানসার নয়, জীবনধারা সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে কোনও ধরনের রোগই মারণরোগ হয়ে উঠতে পারে। সারা দিন ধরে আমাদের শরীরে যত ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার মেরামতি চলে ঘুমের মধ্যে। ঘুমের সময় কমে এলে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) উপাদানটিও মেরামত হয় না। আর এটিই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার একটি বড় কারণ।”
এ বিষয়ে দুই চিকিৎসকেরই পরামর্শ, শুধু স্বাস্থ্যকর খাবার খেলেই হবে না। সার্কাডিয়ান সাইকেলটি আগে ঠিক করতে হবে। অর্থাৎ শরীরের যে নিজস্ব ছন্দ, তাতে ব্যাঘাত ঘটানো চলবে না। পাশাপাশি, ঘুম যাতে গভীর হয়, তার জন্য ঘুমোতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে সব রকম মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। বিশেষ করে যে সব যন্ত্র থেকে ব্লু লাইট নির্গত হয়, সেই সব ডিভাইজ়ের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্যাফিন জাতীয় কোনও খাবার, পানীয় খাওয়া যাবে না। তবে চাইলে বই পড়া যেতে পারে।