মস্তিষ্ককে না খাটিয়ে খাটিয়ে এই হাল করলেন!
কিচ্ছু মনে থাকে না? নাম-ধাম-ঘটনা, কোথায় চাবি কোথায় চশমা? ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভেবে কূল পান না কী জন্য এসেছিলেন? আর ভাবেন, এ নিশ্চয়ই ডিমেনশিয়ার সূত্রপাত৷ এ বার অ্যালঝাইমার্স এল বলে! পরিবারে কারও ছিল কি না খুঁজে বেড়ান৷ বা মানসিক চাপ, হাইপোথাইরয়েড কি ডায়াবিটিসের উপর দোষ চাপিয়ে নিজে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যান৷ কিন্তু ভুলেও ভাবেন না যে, নিজের দোষেই এমনটি হল৷ মস্তিষ্ককে না খাটিয়ে খাটিয়ে এই হাল করলেন! আর তাতে সঙ্গত দিল আজন্ম কালের কিছু বদভ্যাস৷
ভাবছেন, ব্রেন তো ২৪ ঘণ্টাই খাটছে, তাকে আলাদা করে আর কী খাটানোর আছে!
আছে৷ শরীরের কথা ধরুন, হাঁটা-চলা, শোওয়া-বসা, নাওয়া-খাওয়া করেন বলে কি আলাদা করে ব্যায়াম না করলে শরীর ফিট থাকে? কিছু অসুখে তো ব্যায়ামই প্রধান ওষুধ৷ মস্তিষ্কেও তাই৷ মনে রাখার সুতোগুলিকে টান টান করে রাখতে গেলে মস্তিষ্কের ব্যায়াম করে যেতে হয়৷ যাকে বলে ব্রেন জিম বা মেন্টাল অ্যারোবিকস৷ যেমন নতুন কিছু পড়া বা শেখা, লেখালিখি বা হবির চর্চা করা, খেলা, নাচ-গান করা, জটিল হিসেব-নিকেশ করা বা কিছু মেন্টাল গেম খেলা৷ কম বয়সে এ সব নিজে থেকেই হয় বলে মনে রাখা নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না৷ বয়স বাড়লে হাজার কাজের চাপে তা হয় না৷ তার সঙ্গে মানসিক চাপ বাড়ে, ঘুম কমে যায়, নানা অসুখ-বিসুখ এসে হাজির হয়, মস্তিষ্কে পড়ে বয়সের ছাপ৷ সবে মিলে মনে রাখার কোষেদের গায়ে মরচে পড়তে থাকে৷
ভাবছেন, এই মুহূর্ত থেকেই মরচে সাফ করবেন? করতে পারেন৷ তবে মনে রাখবেন, ব্রেন অ্যারোবিকস কিন্তু শরীরের ব্যায়ামের মতো না৷ বছরের পর বছর এক ব্যায়াম করলে হয় না৷ ব্রেনকে খাটাতে হয় নতুন নতুন পথে৷ নতুন কৌশল শিখতে হয়৷ প্রতিকূলতার মুখে ফেলে সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হয়৷ তবেই স্মৃতিশক্তি বাড়ে৷ অ্যালঝাইমারের আশঙ্কা কমে ৭০ শতাংশের মতো৷
মস্তিষ্কে পড়ে বয়সের ছাপ৷
কীভাবে করবেন
১। নানা স্বাদের বই পড়ুন৷ সকালে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কিছু পড়লে, দুপুরে পড়ুন রহস্য কিংবা বিনোদন কিংবা হাসির গল্প৷ বিকেলে যুদ্ধের খবর পড়লে রাতে রোম্যান্টিক গল্প পড়ুন৷ এক দিন কম্পিউটার নিয়ে পড়লে, অন্য দিন পড়ুন মনস্তত্ত্ব— এ রকম৷ এতে এক এক সময়ে ব্রেনের এক এক অংশ উদ্দীপিত হয়ে পুরো মস্তিষ্কের ওয়ার্কআউট হবে৷ পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে গেলে, বয়স হলে যা হয় বা পড়ামাত্র ভুলে গেলেও চিন্তা নেই৷ নিজের উপর বেশি জোর খাটাবেন না৷ যখন যেটা পড়তে ইচ্ছে করছে, পড়ে যান, এক পাতা বা আধপাতা হলেও কাজ হবে৷
২। মাঝেমাঝে জোরে জোরে পড়ুন৷ শব্দগুলি কানে ঢুকলে বেশি ভাল কাজ হবে৷ বা পড়ার পর কারও সঙ্গে আলোচনা করুন৷ বাচ্চাদের গল্প পড়ে শোনাতে পারেন৷ স্মৃতি থেকে বললে আরও ভাল৷
৩। নতুন ভাষা শিখতে পারেন৷ যে ভাবে বাচ্চারা শেখে৷ পড়ে, শুনে, বলা প্র্যাকটিশ করে৷ এক এক সময় মস্তিষ্কের এক এক অংশে উদ্দীপনা ছড়াবে৷ স্মৃতিশক্তি বাড়বে৷ ভাল থাকবে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য৷
৪। লেখালিখি শুরু করুন৷ সে কবিতা হোক বা গদ্য৷ রোজনামচা হোক বা প্রবন্ধ৷ নতুন প্লট ও শব্দের খোঁজে মস্তিষ্কের এ মাথা ও মাথা তোলপাড় করে ব্যায়াম হবে৷ মাঝেমাঝে বন্ধুবান্ধব মিলে স্বরচিত গল্প-কবিতা পাঠের আসর বসাতে পারলে তো কথাই নেই৷
৫। কোনও হবি থাকলে তার চর্চা করুন মন দিয়ে৷ তা সে ছবি আঁকা হোক বা সেলাই করা, রান্না করা হোক বা ঘর সাজানো, বাগান করা হোক বা সমাজ সেবা করা৷ যে কাজে আনন্দ পাবেন, সে কাজে ব্রেনও বেশি সক্রিয় থাকবে৷
৬। গান-বাজনা শুনুন৷ গলা ছেড়ে গান করুন৷ কথা ভুলে গেলেও গেয়ে যান৷ আস্তে আস্তে কথাগুলি মনে পড়বে৷ এতে ব্রেনের ব্যায়াম হবে, কমবে মানসিক চাপ৷ স্মৃতিশক্তি বাড়বে৷ গান বা বাজনা কিছু একটা শিখতে পারলে আরও ভাল৷
৭। হাঁটু-কোমরের অবস্থা বুঝে নাচের ক্লাসে যোগ দিন৷ মন ভাল হবে, শরীরের ব্যায়াম হবে আর সেই সুবাদে অক্সিজেনের জোগান বেড়ে তরতাজা হবে মস্তিষ্ক, নতুন ধাপ শেখার মাধ্যমে মস্তিষ্কেরও ব্যায়াম হবে৷ একই কারণে খেলাধুলাও করতে পারেন৷ এর পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে কিছু মস্তিষ্কের খেলাম খেলুন৷
ব্রেন গেম
১। বাজারের ফর্দ লিখবেন না৷ মনে মনে আওড়াতে থাকুন৷ প্রথম দিকে ১০টার মধ্যে ৫টা হয়তো সময়ে মনে পড়বে না৷ কিন্তু এই পদ্ধতি চালিয়ে গেলে এক সময় দেখবেন ভুলের হার কমছে৷
২। ৩-৪ জন মিলে মেমোরি গেম খেলতে পারেন৷ প্রত্যেকে একটি করে জিনিসের নাম বলুন, সঙ্গে আগের জনেরা যে যে নাম বলেছেন সেগুলিও বলতে হবে৷ খেলা যত এগোবে তত নামের সংখ্যা বাড়বে৷ এই খেলা সিনেমার নাম, ফুল-ফল বা, কোনও জায়গা বা নাম দিয়েও খেলতে পারেন৷
৩। শব্দজব্দ সমাধান করুন৷ একা বা কয়েকজন মিলে৷ পুরোটা করতে না পারলে টেনশন করবেন না৷ মিলেমিশে করলে যে মজা ও উদ্দীপনা পাবেন, তাতেই স্মৃতিশক্তি বাড়বে৷ বাড়বে যুক্তিবোধ৷ সুদোকু করলে বা দাবা খেললেও একই উপকার পাবেন৷
৪। অনলাইনে অনেক ব্রেন ট্রেনিং অ্যাপ আছে, কিছু পয়সার বিনিময়ে সে সবও খেলতে পারেন৷ এর পাশাপাশি জীবনযাপনের সামান্য কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে পারলে, কাজ হবে একশোয় একশো৷
জীবনযাপনের নিয়ম
১। ভাল করে ঘুমান৷ দিনে ৬-৯ ঘণ্টা ভাল ঘুম হলে ভেসে বেড়ানো স্মৃতিগুলি একত্রিত হয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়৷ মানসিক চাপ কমে যায়৷ সে বাবদেও স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়৷
২। নিয়মিত ব্যায়াম করুন৷ দেখা গেছে সপ্তাহে ৩ ঘণ্টা ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের জোগান বেড়ে মাত্র ৬ সপ্তাহে স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়৷ মানসিক চাপ কমে বলেও কাজ হয়৷
৩। সোজা হয়ে বসুন৷ চলাফেরাও করুন শিরদাঁড়া সোজা রেখে৷ ব্রেন বেশি অক্সিজেন পাবে৷
৪। পছন্দের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলুন৷ দিনে অন্তত মিনিট দশেক হালকা চালে গল্পগুজব করলে স্মৃতিশক্তির ওপর ভাল প্রভাব পড়ে বলে জানা গেছে৷
৫। হাসির অনুষ্ঠান দেখুন৷ হাসির বই পড়ুন৷ লাফিং ক্লাবেও যেতে পারেন৷
৬। এমন ভাবে খাওয়া-দাওয়া করুন যাতে সঠিক পুষ্টি হয় অথচ ওজন না বাড়ে, শরীর সুস্থ থাকে৷
৭। কোনও ক্রনিক অসুখ-বিসুখ থাকলে চিকিৎসা করে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন৷