এডস অসুখটা প্রাণঘাতী বটে, কিন্তু সকলের সচেতনতা আটকে দিতে পারে এডসের বাড়বাড়ন্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী প্রত্যেক বছর ২০ লক্ষ মানুষ নতুন করে এডসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে ২ লক্ষ ৭০ হাজার শিশু। তাই সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে বিশ্ব এডস দিবস পালন করা হয়। আর এতে কাজও হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। আমাদের দেশে প্রথম এইচআইভি রোগীর হদিস মেলে ১৯৮৬ সালে, চেন্নাইতে। যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে এইচআইভি রোগী শনাক্ত করেন চিকিৎসকেরা। তার পর কয়েক বছরের মধ্যে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে এই মারণ রোগের সংক্রমণ। তবে আশার কথা, গত ২৯ বছর লাগাতার প্রচারের ফলে আমাদের দেশে এইচআইভি-র সংক্রমণ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে বলে জানিয়েছে ন্যাকো, অর্থাৎ ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অরগানাইজেশন।
এ বার জেনে নেওয়া যাক এডস-এর লক্ষণ সম্পর্কে। এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর কিছু দিন চুপচাপ বসে থাকে। রোগ নির্ণয় হলে আর ঠিকমতো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ খেলে খুব একটা সমস্যা হয় না। কিন্তু বিনা চিকিত্সায় ফেলে রাখলেই বিপদে পড়তে হয়। এই অসুখের তিনটি পর্যায় আছে।
১) প্রথম পর্যায়: অ্যাকিউট এইচআইভি ইনফেকশন।
২) দ্বিতীয় পর্যায়: ক্রনিক এইচআইভি ইনফেকশন।
৩) তৃতীয় পর্যায়: এডস।
এইচআইভি শরীরে প্রবেশ করার পর দুই থেকে ছয় সপ্তাহ কিছুই বোঝা যায় না। এর পর থেকে ভাইরাল ইনফেকশনের মতো জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। সপ্তাহখানেক থেকে চলে যায়, আবার হয়। যে সব উপসর্গ দেখা দেয়, সেগুলি হল-
• গা ম্যাজম্যাজ।
• মাথাব্যথা-সহ গা-হাত-পায়ে ব্যথা।
• জ্বর।
• পেট খারাপ।
• বমি বা বমি বমি ভাব।
• গলা ব্যথা।
• শরীরের বিভিন্ন অংশে লাল লাল র্যাশ (বিশেষত শরীরের ওপরের দিকে)।
• লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।
তবে সাধারণ ভাইরাল ফিভারেও এই ধরনের উপসর্গ দেখা যেতে পারে। তাই রোগটা চট করে ধরা পড়ে না। এ ক্ষেত্রে রোগী যদি তাঁর জীবনযাত্রার কথা নিঃসঙ্কোচে চিকিত্সককে জানান তবে সহজে অসুখটা নির্ণয় করা যায়। পরিবারে কারও এই অসুখ থাকলে চিকিত্সককে তা জানানো উচিত। এই সময় থেকেই চিকিত্সকের পরামর্শে নির্দিষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ খাওয়া শুরু করা উচিত।
প্রথম পর্যায়ে রোগটা ধরা না পড়লে এইচআইভি ক্রমশ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (বিশেষ ধরনের কোষ CD4 T-cells যা আমাদের রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে ) ধ্বংস করতে শুরু করে। এই সময়ে জ্বর আর জ্বর জ্বর ভাব ছাড়া বিশেষ কোনও উপসর্গ না থাকলেও রক্তপরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যায়। সঙ্গে কিছু ওষুধ খাওয়া ও রোজকার জীবনযাত্রায় কিছু রদবদল ঘটিয়ে ফেলতে পারলে সুস্থ থাকা যায়। কম্বিনেশন ড্রাগ শরীরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিছুটা ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে সাবধানে থাকতে হয় ও নিয়মিত চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হতে পারে।
তবে এই সময়েও অসুখ ধরা না পড়লে অসুখটা তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। রোগ প্রতিরোধক CD4 T-কোষ প্রচুর পরিমাণে ধ্বংস হয়ে যায়। সাধারণ ভাবে প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে ৪০০ থেকে ১৪০০ CD4 T-কোষ থাকে। তৃতীয় পর্যায়ে তা কমে দাঁড়ায় ২০০ বা তারও নীচে। এই অবস্থায় ত্বকের জটিল সমস্যা থেকে ফুসফুসের জটিল অসুখ-সহ আরও মারাত্মক নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
• কোনও কারণ ছাড়াই হু হু করে ওজন কমতে শুরু করে।
• সারা ক্ষণ গা ম্যাজম্যাজ করে, কোনও কাজ করতে ভাল লাগে না। সব সময় ঘুম ঘুম ভাব, কোনও কাজে মনোযোগ দেওয়া যায় না।
• ১০ দিন বা তারও বেশি সময় ধরে জ্বর চলতেই থাকে। ১০২ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর উঠে যায়।
• লাগাতার ডায়েরিয়া চলতেই থাকে।
• সামান্য পরিশ্রমে হাঁফ ধরে, নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়।
• মুখে, ঠোঁটে, গলায়, জিভে ও যৌনাঙ্গে ইস্ট-এর সংক্রমণ হতে পারে।
• শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত হয়, কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
• হাঁটু, কোমর, পিঠ-সহ শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে ব্যথা যন্ত্রণা হয়।
• শুকনো কাশি চলতেই থাকে, অ্যান্টিবায়োটিক বা ইনহেলারেও কাজ হয় না।
• বুকে সর্দি বসে গিয়ে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
• সারাক্ষণ মাথাব্যথা করে।
• নখ পুরু হয়ে বেঁকে যেতে পারে।
• কোনও কাজে মনঃসংযোগ করা যায় না, ছোটখাট ঘটনার কথা ভুলে যায়। একে বলে এডস রিলেটেড ডিমেনশিয়া।
কয়েক বছর আগেও এডস আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হত। যাদের ভগ্ন স্বাস্থ্য আর অতিরিক্ত অসংযত জীবন, তাদের বাঁচার মেয়াদ ছিল আরও কম। ইদানীং Antiretroviral therapy (ART) ওষুধের সাহায্যে এবং সামগ্রিক স্বাস্থের উন্নতি করে এইচআইভি আক্রান্তকে অনেক দিন ভাল রাখা যায়।