বাংলা শব্দের খেলা
‘জুজু, জুজু, আমাকে থাবা দিওনি’ — বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর গান থেকে টুকলি করলাম লাইনটা। বাংলা ভাষার জুজুর এমন মহিমা, হিমালয়-চেহারার বাংলা অভিধান ক’জনের বাড়িতে আছে, আর থাকলেও কত বার সেটা খোলা হয় তা নিয়ে বেশ সন্দেহই রয়েছে। বাংলা ভাষা এমনই এক জুজু, যার থাবার ভয়ে বাবা-টু-ছেলে, মা-টু-মেয়ে, সব্বার হাতে হ্যারিকেন; আত্মসম্মানে আলকাতরা।
All কাতরা? আরে দূর, বাংলায় কেউ কাতরায় নাকি! বানান ভুল হলে যেখানে নম্বর কাটা যাবে না, সেখানে কাত খাওয়াবে কে? প্রমানের তাই প্রয়োজনই নেই। মাছের ছানাকে কেউ কখনও জিজ্ঞেস করবে নাকি, বল দেখি জল কয় প্রকার ও কী কী? সাগরের জল থেকে আহ্লাদে গলে জল, মাছ সাঁতরে পেরিয়ে যাবে। জীবনে ফেল করবে না। বাঙালিও বাংলায় ফেল করে না, ওই, নম্বর একটু কম পায়— এই আর কি! মাধ্যমিক আর বোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে সমাস ভুলে যায় ছ’মাসে। সন্ধির সঙ্গে ঝগড়া করে আনফ্রেন্ড করে দেয় ন’মাসে। কিন্তু বাংলা কি ভোলে?
‘আমি সেই জুজু, যার এত নাম-গান
Total area জুড়ে ভয়ের দোকান।’
দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা সব থেকে বেশি জুজু। বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞপ্তিতে তো বটেই — ‘লক্ষীভান্ডার’, ‘দূর্গা হার্ডওয়্যার স্টোর’, ‘করুনাময়ী বাস স্ট্যান্ড’, ‘এখানে বাস দাড়াবে না’, ‘পকেট মার হতে সাভদান’, ‘নিরামিস আহার পাওয়া যায়’, ‘রামকৃষ্ণ শাড়ী ঘড়’ — আরও কত কী! গত ১৩ বছর ধরে বাংলা শব্দের খেলা 'শব্দবাজি'-র একটা বিভাগ কাজ করছে, যার নাম 'শব্দপুলিশ'। এর মাধ্যমে বাংলা বানান ও ভাষার এমন ভুলগুলোই ধরিয়ে দিই আমরা; ধরিয়ে দেন সচেতন বাঙালিরা-ই। শব্দবাজির ফেসবুক পেজে, ইমেলে ভুলের ছবি আসে নিয়মিত। এবং শয়ে শয়ে ভুল দেখে মনে হয়, বাঙালি এত ভুল সয় কী করে? আসলে সয় যে না তা নয়, খেয়াল-ই করে না যে ভুল হয়েছে!
'প্রমাণের' তাই 'প্রয়োজন-ই' আছে, যে বাংলা শব্দের আর ভাষার ভুল আমাদের হয়। বারবার দেখিয়ে দিলে তবেই আরও অনেক বেশি বাঙালি সচেতন হবে ভাষা আর বানান সম্পর্কে। আর এই সচেতনতা মাধ্যমিক বোর্ড পেরিয়ে শুরু করলে অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে। কারণ, তত দিনে খুদে মাছ পাড়ার পুকুরের জলে সাঁতার কেটে মহাসাগরে ঝাঁপ দিতে তৈরি। তার দায় পড়েছে আলাদা করে বাংলা শুধরে নেওয়ার, যদি না বাংলা লিখে-বলে তার পেট চলে।
তাই জুজু মারতে হবে প্রথমের দিকেই। ভীতি কাটিয়ে ভিত শক্ত করতে হবে পাড়ার পুকুরেই, জেলার জলেই। তাই তো আনন্দবাজার অনলাইন আয়োজিত ‘শব্দ-জব্দ’ গত বছর থেকে আন্তঃ-স্কুল এবং আন্তঃ-জেলা শব্দের খেলার লড়াই নিয়ে জল মাপতে আট-ঘাট বেঁধে নেমেছে। ৬টা জেলার ১০১টা স্কুলে গিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পর্বের খেলা খেলানোর পরে প্রত্যেক স্কুলের তিন জন পড়ুয়া নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল স্কুল-দল। যারা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসে ৯ নভেম্বর, ২০২২, দক্ষিণ কলকাতার উত্তম মঞ্চে। প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা ধরে তিনটে পর্বে যুদ্ধ করে, শেষ অবধি তিনটে দল সেরা তিন জায়গা দখল করে।
জুজু কাটানোর এ যুগের হুজুগ হোক শব্দ-জব্দ, এটাই তো লক্ষ্য এখন। মজার মজার শব্দের খেলার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আরও সহজ, আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা। বনের বাঘ হোক, বা চিড়িয়াখানার–সে তার মাতৃভাষা হালুমভাষা কখনওই ভোলে না। বাঙালি তো নিজেকে বাঘের বাচ্চা বলতে ভালবাসে। তা সেই বাঙালি-বাঘ(বা-বা) জেলার জন-জঙ্গল থেকে বিশ্বের জন-বৃহদারণ্যের জায়গায় জায়গায় পৌঁছে গিয়ে তার হালুমপনায় ভুল করবে, আত্মসম্মানে আলকাতরার আলপনা আঁকবে, তা যেন না হয়।
জুজুর থাবা বা-বার থাবার ঘায়ে অক্কা পাক, শব্দ-জব্দ আর শব্দবাজি সাক্ষী থাক।