গ্রাফিক: সুমন চৌধুরী
শব্দ ধাঁধার জন্ম সাগরপারে। ১৯ শতকের ইংল্যান্ডে। তখন তার জায়গা ছিল শুধুমাত্র ছোটদের বইয়ের পাতায়। কচিকাঁচার দল চার থেকে ছয় ছকের ক্রসওয়ার্ডের সমাধান করত।
পরবর্তী সময়ে সেই খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আমেরিকায়। শুধু ছোটরা নয়, শব্দছকের সমাধান বড়দেরও অবসরের অভ্যাস হয়ে ওঠে।
১৯১৩ সালে শব্দ ছকের খেলা জায়গা করে নেয় সংবাদপত্রের পাতায়। নেপথ্যে ছিলেন সাংবাদিক আর্থার উইন। বিশ্বের প্রথম প্রকাশিত ক্রসওয়ার্ড পাজ়ল তৈরি করেন ইংল্যান্ডের লিভারপুলের এই সাংবাদিক। তবে এ নিয়ে মতভেদের অবকাশ থেকেই যায়।
১৯১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামে দৈনিক পত্রিকার রবিবারের বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘ফান’-এ প্রকাশিত হয় প্রথম ক্রসওয়ার্ড পাজ়ল। বড়দিনের উপহার হিসেবে। আর্থার উইন ছিলেন ওই পত্রিকার কমিকস বিভাগের সম্পাদক। তবে বিশ্বের প্রথম প্রকাশিত ক্রসওয়ার্ডটি কিন্তু আজকের চেনা শব্দ ছকের মতো ছিল না। তার আকার ছিল হিরের মতো। পাজ়লের একদম উপরে তিনটি ঘরে তিনি লিখে দিয়েছিলেন ‘ফান’। বাকি ছকে নম্বর দিয়ে লেখেন সমাধান সূত্র।
ক্রসওয়ার্ড পাজ়লের প্রথম নাম ছিল ‘ওয়ার্ডক্রস পাজ়ল’। পরের সপ্তাহেই মুদ্রণ প্রমাদে সেই নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ক্রসওয়ার্ড পাজ়ল’। অন্য একটি মত বলে, সাংবাদিক আর্থার নাকি নিজেই উল্টে দিয়েছিলেন শব্দটি। সেই নামেই জনপ্রিয় হয় শব্দ জটের খেলা।
তবে শব্দ জব্দের রেওয়াজ কিন্তু আগেও ছিল। ইতালির পম্পেই শহরে লাতিন ভাষায় এই খেলার চল ছিল। বর্গাকৃতির ছকে খেলা হত। যার নাম ছিল ম্যাজিক স্কোয়ার।
পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই গোটা আমেরিকা মেতে ওঠে শব্দ ছকের খেলায়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দমবন্ধ পরিস্থিতিতে সহজ, নির্মল আনন্দের জন্য নতুন কিছুর স্বাদ খুঁজছিল সাধারণ মানুষ। সেই থেকেই শব্দ জব্দের খেলা অনেকের কাছেই নেশা, অনেকের কাছে সমস্যা সমাধানের গাইড। শব্দ জটের সমাধান না করে তাঁদের একটা দিনও কাটে না। পৃথিবীর প্রবীণতম শব্দ খেলাড়ুর নাম বার্নিক গর্ডন। ১০১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি নিয়ম করে শব্দ জব্দের সমাধান করতেন। ১৯২০ সালে প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন ক্রসওয়ার্ড পাজ়লের। প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত শব্দ ছক ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ২০১৫ সালে তিনি প্রয়াত হন।
গিনেস বুক অফ রের্কড অনুযায়ী ২০১২ সালে ফিনল্যান্ডে বিশ্বের বৃহত্তম শব্দ জটের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ১৮,০৮৩ স্কোয়ার ফিট জায়গা জুড়ে ১ লক্ষের বেশি ক্রসওয়ার্ড স্কোয়ার তৈরি হয়েছিল। রীতিমতো দল গড়ে সমাধানের খেলা চলেছিল।
ব্রিটিশ ডিজ়াইনার নেইল ডেভিডশন বিশ্বের সবচেয়ে দামি শব্দ ছকটি তৈরি করেছিলেন, যাতে ছিল ১৮ ক্যারাট সোনা এবং ৬ হাজার হিরে। ১.৩ মিলিয়ন ডলারে সেটি কিনেছিলেন এক সংগ্রাহক। সমাজসেবামূলক কাজে অর্থ সাহায্যের জন্যই এটি তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৭৮ সালে শুরু হয় ‘আমেরিকান ক্রসওয়ার্ড পাজ়ল টুর্নামেন্ট’। সেখানে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শব্দ ছকের সমাধান করতে হয় প্রতিযোগীদের।
ক্রসওয়ার্ড পাজ়ল সমাধানের জন্য আছে বিশেষ অভিধানও। নবীন-প্রবীণ সব খেলোয়াড়দের সাহায্যের জন্য এটি তৈরি। এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে নিয়মিত ক্রসওয়ার্ড প্রতিযোগিতার আসর বসে।
শব্দ ছকের সমাধানে বিশ্ব জুড়ে গড়ে উঠেছে পাজ়লপ্রেমীদের কমিউনিটি আর ফোরাম। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আছে এমন নানা গ্রুপ। শব্দ ছক সমাধানের নানা রকম স্ট্র্যাটেজি, মজার খেলা নিয়ে নতুন ভাবনার আদানপ্রদান করেন ধাঁধাপ্রেমী মানুষ। সেই ভাবনাকেই সঙ্গী করেই বাংলার স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে শব্দ জব্দের মজার খেলায় মাতৃভাষার প্রতি টান এবং ভাষার ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করতে উদ্যোগী আনন্দবাজার অনলাইন। শুরু হয়ে গিয়েছে ‘শব্দ জব্দ’ ২০২৪। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে এই প্রতিযোগিতায় বেছে নেওয়া হবে সেরা স্কুল। আর এ ভাবেই নতুন প্রজন্মের হাতে নতুন প্রাণ পাবে বাংলা ভাষা।