এই নিয়ে দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করল আনন্দবাজার অনলাইন আয়োজিত শব্দ-জব্দ। বহু স্মৃতি। কত সব মজার গল্প। গত বছর যখন স্কুলগুলোতে শব্দ-জব্দ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম, তখন বহু শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই আলাপ হয়েছিল। কেউ আমায় চেনে, কেউ বা চেনে না। সেই যাই হোক না কেন, বাংলা নিয়ে তারা বা তাদের অভিভাবক, শিক্ষকেরা কতটা মনোযোগী তা ঠিক টের পেয়েছিলাম। এমনই একটা ঘটনা শোনাই।
– বাংলা গান শোনো তোমরা?
– হ্যাঁ।
– আর হিন্দি গান?
– হ্যাঁএএএএএএ!
দক্ষিণ কলকাতার একটা বাংলা মাধ্যম মেয়েদের স্কুলের ক্লাসরুম। উত্তর দেওয়ার তেজেই টের পেয়েছিলাম আমরা, আমাদের ছেলেমেয়েদের কানে বাংলা গানটা ঠিক আসে না।
– এই শব্দটা আমার ঠাকুমার মুখে শুনেছি। She was a Bengali teacher। দূরভাষ মানে টেলিফোন, right Sir?
উত্তর কলকাতার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। শব্দটা মোবাইলের যুগে আর হয়ত সেই ভাবে ব্যবহার হয় না। কারণ টেলিফোনই তো সে ভাবে ব্যবহার হয় না। মোবাইলেরও কয়েকটা ভাল ভাল বাংলা শব্দ আছে। চলভাষ (চলমান যে দূরভাষ), মুঠোফোন ইত্যাদি। তবে এ সবের থেকে, ‘মোবাইল’ শব্দটা সহজ। তাই এর ব্যবহারও বেশি।
– বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, ব্যোমকেশ, ফেলুদা, লীলা মজুমদার…আর, আর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আরও অনেক বই পড়েছি। ক্লাসের পড়া করতে ইচ্ছে না করলে তখন বই পড়ি, মোবাইলে অডিও স্টোরি শুনি।
আবার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। নবম শ্রেণির ছাত্রী। বাড়িতে মা-বাবা বাংলা বই কিনে দেন। গল্পের বই পড়ার-শোনার অভ্যাসের অনেকটাই ঘরতুতো।
একটা হাতে লেখা চিঠি পেয়েছিলাম আমরা। হাতে লিখে ছবি তুলে পাঠানো হয়েছিল। সুন্দর হাতের লেখায় সে জানিয়েছিল, এমনই মজার মজার শব্দের খেলার মাধ্যমে চেনা বাংলা শব্দগুলোকে দেখতে ওর খুব ভাল লেগেছে। ও আরও খেলতে চায়। শব্দ-জব্দ আরো বেশি করে যেন হয়। চিঠি এসেছিল হুগলি জেলার বাংলা মাধ্যম স্কুলের এক ছাত্রীর কাছ থেকেও।
গত বছর, শব্দ-জব্দর যাত্রা শুরুর বছরে, আমরা পশ্চিমবঙ্গের মাত্র ৬টা জেলায়, এবং সরকারি-বেসরকারি সব মিলিয়ে মাত্র ১০১টা স্কুলে যেতে পেরেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার স্কুলের মধ্যে দুই মাধ্যম মিলিয়ে, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত, বাঙালি শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে ৭০-৮০ লাখ হবেই। সেখানে মাত্র ২০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কাছে আমরা পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম। ওদের সঙ্গে শুধু শব্দ নিয়ে খেলা তো নয়, টুকটাক আড্ডার মাধ্যমে ওদের কাছ থেকে আমরা এটাও জানার চেষ্টা করেছি যে বাঙালিয়ানার নানান উপাদান ওরা কী ভাবে গ্রহণ করে। বা আদৌ করে কিনা! কারণ, বাংলা ভাষা আর তার নানান শব্দ মিশে আছে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে, আমাদের সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে।
হিন্দি গানের জনপ্রিয়তা যেমন ধরা পড়েছে, জানা গিয়েছে এটাও যে খুব পুরনো বাংলা গান তারা শোনে না। বাংলা বইয়ের মধ্যে সিলেবাসের বাইরের গল্প, বা গল্পের বই পড়ার চল একটু কমই। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মোবাইল খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আর তার ব্যবহার তারা করে পড়াশোনা আর বিনোদনের জন্য। সেখানেও বাংলা ভাষার বিষয়, বা কন্টেন্ট তারা খুব একটা দেখে না। হিন্দি, বা ইংরেজির, এমনকি কে-পপ বা দক্ষিণ কোরিয়ার গান ইত্যাদিও তাদের অনেকের কাছে জনপ্রিয়। বাংলা গানের মধ্যে এই সময়ের বাংলা সিনেমার গান, কিছু বাংলা ব্যান্ডের গান তাদের বেশি পছন্দের। বাড়িতে টিভিতে যে অনুষ্ঠান দেখা হয়, তার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় তাদের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ার (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব) বিনোদন বা বিষয়। সব ক্ষেত্রেই মূলত স্কুলের পাশাপাশি, বাড়িতে সংস্কৃতি চর্চার চল থাকলে তার প্রভাব ছাত্র-ছাত্রীদের কথায় ধরা পড়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্ষেত্রে অনেকেরই বাংলা শব্দ চিনতে অসুবিধে হয়েছে, তবে বাংলা মাধ্যমের সবাই বা বেশিরভাগ বিদ্যার্থী যে বাংলা শব্দ সহজেই চিনে ফেলেছে, তা-ও নয়।
ফলে, এক দিকে যেমন খানিকটা অস্বস্তি, হতাশা, দুঃখ ঘিরে ধরেছে আমাদের, অন্য দিকে শব্দ-জব্দ আর বাংলা শব্দের খেলার মাধ্যমে ওদের মধ্যে বাংলা শব্দ আর ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার জেদটা আমাদের গত বছর থেকেই পেয়ে বসেছে। ওরাই তো ভবিষ্যতের বাঙালি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোত ওদের মাধ্যমেই আগামীর দিকে ছুটে যাবে। সেই স্রোতের গুণগত মান বাড়াতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আমরা বদ্ধপরিকর। শব্দ-জব্দ দ্বিতীয় বছরের জয়যাত্রার দিকে আমরা তাই সাগ্রহে তাকিয়ে। আমরা করব জয়, নিশ্চয়…