২০১৭ সালটা আক্ষরিক অর্থেই, আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে হয়ে উঠতে চলেছে একটি ‘মাইলস্টোন ইয়ার’!
জীববিজ্ঞান থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, কণাপদার্থবিজ্ঞান, বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক্স, নিউরোসায়েন্স, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ভাইরোলজির গবেষণার ক্ষেত্রে এই একুশ শতকে একটি মনে রাখার মতো বছর হয়ে উঠতে চলেছে ২০১৭। তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, গভীর অধ্যবসায় আর অতন্দ্র গবেষণার নিরিখে এমন পূর্বাভাসই দিচ্ছেন দেশ ও বিদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান গবেষকরা।
বিজ্ঞানী, গবেষকদের আশা, প্রত্যাশা, পূর্বাভাসের নির্যাস- ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) ও পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য ভিন গ্রহের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে একটি চিরস্মরণীয় বছর হয়ে উঠতে পারে ২০১৭।
সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার
সুপারসিমেট্রি কণা আবিষ্কারের জোর সম্ভাবনা এ বার লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে
একশো বছর আগে ১৯১৭-র ‘বলশেভিক বিপ্লবে’র পর ২০১৭ সত্যি-সত্যিই হয়ে উঠতে পারে একটি ‘বৈপ্লবিক সময়’, যখন পৃথিবীকে বাঁচাতে মানবসভ্যতা শুরু করে দেবে গ্রহাণু বা অ্যাস্টারয়েড ও চাঁদে খনিজ পদার্থের সন্ধান আর তা তুলে আনার অভিযান। এই প্রথম, বাণিজ্যিক ভাবে। আর পদার্থবিজ্ঞান যা পারেনি এখনও, সেই সময়কে (টাইম) পিছন দিকে হয়তো ‘ছোটাতে’ পারবে স্নায়ুবিজ্ঞান বা নিউরো-সায়েন্স, বয়স বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা বার্ধক্যের (এজিং) ‘রথ’কে কিছুটা হলেও, থামিয়ে দিতে বা সামনের দিকে তার হুড়মুড়িয়ে ছুটে চলার গতি কমিয়ে দিতে!
কী প্রত্যাশা তাঁদের নতুন বছরে, তাঁদের গবেষণার ক্ষেত্রে কোন কোন ‘ব্রেক-থ্রু’ বা বড় কোন অগ্রগতির আশা করছেন তাঁরা, ২০১৭-য় কোন কোন আবিষ্কারের আশায় তাঁরা দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না উত্তেজনা, উৎকণ্ঠায়, তা জানতে গত ১০ দিন ধরে আনন্দবাজারের তরফে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, পুণে, আমদাবাদ ও আমেরিকা, সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানিতে থাকা বিশিষ্ট বাঙালি বিজ্ঞানী ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিভাবান গবেষকদের সঙ্গে। কথা বলা হয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো এবং দু’টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাসা ও সার্নে কর্মরত বাঙালি ও বিদেশি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। ই-মেলে, টেলিফোনে, হোয়্যাটসঅ্যাপ, স্কাইপে। বিজ্ঞানীদের সেই বক্তব্যেরই নির্যাস তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।
২০১৭-য় বিজ্ঞানের এই সব ক্ষেত্রে ‘ব্রেক-থ্রু’ বা কোনও সাড়াজাগানো আবিষ্কারের প্রত্যাশায় রয়েছেন বিজ্ঞানীরা
১) আমাদের সবচেয়ে কাছের সৌরমণ্ডলে প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’র মতো আরও বেশ কয়েকটি বাসযোগ্য ভিন গ্রহের আবিষ্কার হতে পারে ২০১৭-য়।
২) এমনকী, আরও দূরের কোনও সৌরমণ্ডলেও বাসযোগ্য ভিন গ্রহ আবিষ্কারের জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। মহাকাশে কেপলার টেলিস্কোপ আর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা টেলিস্কোপগুলির ব্যাস ও সেনসিটিভিটির ‘আপগ্রেডেশন’ই সেই ভরসা জোগাচ্ছে বিজ্ঞানীদের।
৩) মঙ্গলে মিলতে পারে ‘প্রাণের স্বাক্ষর’ বা ‘বায়ো-সিগনেচার’। মিলতে পারে তার অন্দরে লুকিয়ে থাকা আরও আরও ‘ওয়াটার আইসে’র হদিশ। মিলতে পারে এখনও ‘লাল গ্রহে’ বয়ে চলা জলের স্রোত!
পৃথিবী (বাঁ দিকে) ও প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি
৪) বৃহস্পতির দুই চাঁদ ‘গ্যানিমিদ’ ও ‘ইউরোপা’ আর শনির চাঁদ ‘টাইটান’-এ মিলতে পারে আরও বেশি জল বা ‘ওয়াটার আইসে’র হদিশ।
৫) গ্রহাণু ‘সেরেস’-এ প্রচুর পরিমাণে ‘ওয়াটার আইস’ মেলায় সেখানেও ‘বায়ো-সিগনেচার’ মেলার সম্ভাবনা রয়েছে যথেষ্ট। আগামী বছরেই।
৬) এ ছাড়াও স্পেস এক্সপ্লোরেশনের ক্ষেত্রে একেবারেই নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে ২০১৭ সালে। যখন এই প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে গ্রহাণু ও আমাদের চাঁদে খনিজ পদার্থের সন্ধানের জন্য মহাকাশ অভিযান শুরু হয়ে যাবে। যাতে নামবে তিনটি মার্কিন সংস্থা।
৭) এর আগে আমরা দু’টি কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোলের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পেয়েছিলাম। এ বার আমেরিকার হ্যানফোর্ড ও লুইজিয়ানায় যে দু’টি লাইগো ডিটেক্টর রয়েছে, তাদের মাধ্যমে দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মেলার সম্ভাবনা যথেষ্টই। প্রযুক্তিগত কারণে ৯ মাস বন্ধ থাকার পর ঠিক সপ্তাহ দু’য়েক আগে আমেরিকার ওই দু’টি ডিটেক্টর আবার কাজে নেমেছে। ফলে, বিজ্ঞানীদের আশা, আরও নিখুঁত ভাবে এ বার হদিশ মিলবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের। তার ফলে তারাগুলি কী ভাবে জন্মায় আর তাদের মৃত্যু হয়, সেটা জানা সহজতর হয়ে উঠবে আমাদের কাছে।
৮) সেই জ্ঞান আমাদের দেশে ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পেও কাজে লাগবে। ২০১৭ সালেই ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যাবে। শুরু হয়ে যাবে তার ভবনগুলি নির্মাণের কাজকর্ম। ভারতে বিজ্ঞান গবেষণায় যা একটি ‘মাইলস্টোন’ হয়ে দাঁড়াবে।
চিনের আসন্ন পোলার মিশনের প্রস্তুতি
১৭) কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি) নিয়ে গবেষণার পালে হাওয়া জোগাতে আগামী বছরেই ‘পিক্সি’ নামে নাসা একটি প্রকল্প শুরু করতে পারে, তা অনুমোদিত হলে। যাতে বহু ভারতীয় বিজ্ঞানী যুক্ত হতে পারেন।
১৮) এ ছাড়াও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মেলার জন্য যদি এ বার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তা হলে একই সঙ্গে ৩৭ জন ভারতীয় বিজ্ঞানীর সামনে একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোকিত হয়ে ওঠার সুযোগটা আসবে ২০১৭-তেই।
১৯) বাইসেপ-২ টেলিস্কোপের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে তিনটি কম্পাঙ্কে। ৯৫, ১৫০ এবং ২২০ গিগা হার্ৎজে। এর ফলে প্রাইমোর্ডিয়াল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের হদিশ মেলার সম্ভাবনা রীতিমতো জোরালো হয়ে উঠবে ২০১৭-য়। ২০১৭-র শেষাশেষি প্রাইমোর্ডিয়াল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের হদিশ মিলতে পারে। প্ল্যা
২০) প্ল্যাঙ্ক পোলারাইজেশন মেজারমেন্ট থেকেও আগামী বছরে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন তথ্য পাওয়ার আশা রয়েছে।
২১) দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যেকার সংঘর্ষের ঘটনা ২০১৭ সালে আমরা আরও বেশি দেখতে পাব। যা আমাদের ‘বাইনারি’গুলিকে আরও ভালো ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
২২) যা আইনস্টাইনের ‘থিয়োরি অফ গ্র্যাভিটি’ এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আরও নিখুঁত ভাবে পরীক্ষা করে দেখতে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুন- আরও স্মার্ট হবে ২০১৭, কিন্তু বাড়ছে বিপদও
২৩) মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক কাউন্টারপার্ট আমাদের ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ হয়তো ২০১৭-তেই খুঁজে পাবে।
ভারতের গর্বের অ্যাস্ট্রোস্যাট
২৪) আমেরিকার দু’টি লাইগো ডিটেক্টর ছাড়াও ২০১৭-য় ইতালির পিসায় বসানো ‘ভার্গো’ ডিটেক্টরটিও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পেতে পারে।
২৫) দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যেকার সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও হদিশ মিলতে পারে ২০১৭-য়।
২৬) ভারতের গর্বের উপগ্রহ-অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর তথ্য বিশ্লেষণ, অপ্রয়োজনীয় তথ্যাদি বিয়োজনের পর ২০১৭ সাল থেকে আক্ষরিক অর্থেই, শুরু হয়ে যাবে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর পাঠানো তথ্য ও ছবির সায়েন্টিফিক ইনফারেন্স, বেশ কিছুটা মডেলিং, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত। যা ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে একটি ‘মাইলস্টোন’ হয়ে থাকবে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ
২৭) ব্রহ্মাণ্ডের এক-তৃতীয়াংশের ওপর নজর রাখতে পারার সুযোগ নিয়ে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ ইতিমধ্যেই ৭৫ থেকে ৮০টির মতো নতুন গামা রে’ বার্স্টের ঘটনা দেখতে পেরেছে। সেগুলির সম্পর্কে আমাদের তথ্য ও ছবি পাঠিয়েছে। যেটা আমাদের অনেক বেশি উল্লসিত করেছে, তা হল- এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রায় শেষ সীমান্ত পর্যন্ত ওই নতুন গামা রে’ বার্স্টের ঘটনাগুলি ‘চাক্ষুষ’ করতে পেরেছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’।
২৮) এখন মাসে প্রায় ৪ থেকে ৫টি করে ওই ধরনের গামা রে’ বার্স্টের ঘটনার হদিশ পাচ্ছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। ২০১৭-য় তা আরও বাড়তে পারে। যা এই ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কাউন্টারপার্টগুলিকেও খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
২৯) ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর পাঠানো তথ্য থেকে নতুন নতুন ব্ল্যাক হোলেরও হদিশ মিলতে পারে।
৩০) এমনকী, দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যেকার সংঘর্ষের ঘটনাও চোখে পড়তে পারে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর। ২০১৭-য়।
নৈনিতালে ভারতের সেই ৩.৬ মিটার টেলিস্কোপ
৩১) এ ছাড়াও ২০১৭-য় সেনসিটিভিটি অন্তত চার গুণ বাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপ- ‘জায়েন্ট মিটার ওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপে’র কাজ শুরু হয়ে যাবে জোর কদমে। এটা ভারতের গর্ব। এতে ৪৫ মিটারের মোট ৩০টি ডিস্ক রয়েছে। এই টেলিস্কোপ ব্রহ্মাণ্ডের সুদূরতম প্রান্তে নতুন নতুন মহাজাগতিক বস্তুর হাল-হদিশ জানতে সাহায্য করবে।
৩২) ২০১৭ সালেই ‘ইউরোসিটা’ নামে জার্মানি একটি এক্স রে’ সার্ভেয়ার পাঠাচ্ছে মহাকাশে, এপ্রিলের মধ্যেই। এটাই বিশ্বের প্রথম ‘অল স্কাই এক্স রে’ সার্ভেয়ার’। এটা নতুন ভিন গ্রহের সন্ধানে তো বড় একটা হাতিয়ার হবেই, নতুন অন্তত ৩০ লক্ষ ব্ল্যাক হোলের হদিশ দিতে পারবে।
৩৩) আগামী এপ্রিলের মধ্যেই মহাকাশে এক্স রে’ স্পেকট্রাম নিরীক্ষণ করতে ‘নাইসার’ পাঠাচ্ছে নাসা। এটা নিউট্রন নক্ষত্রগুলির ভর ও ব্যাসার্ধ মাপতে আমাদের অনেক বেশি সাহায্য করবে।
৩৪) ভারতের জন্য আরও সুখবর রয়েছে ২০১৭-য়। নৈনিতালের ‘এরিজ’-এ কাজ শুরু করবে এশিয়ার বৃহত্তম ৩.৬ মিটারের টেলিস্কোপ। আগামী বছরেই ‘পোলার মিশন’ পাঠাচ্ছে চিন।
৩৫) চিনের ওই ‘পোলার মিশন’ ২০১৭-য় ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে পোলারাইজেশন মাপার কাজটাকে সহজতর করে তুলবে।
৩৬) দীর্ঘ দিন পর শেষ পর্যন্ত ২০১৬-য় ভারত ‘অ্যাসোসিয়েট মেম্বার’ হয়েছে ‘সার্ন’-এর। তার দৌলতে দেশের কম্পিউটিং ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। তার ফলে দেশের যাবতীয় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আর সেই সব যন্ত্রপাতি-নির্ভর যাবতীয় কর্মকাণ্ড অনেক বেশি দ্রুততর হয়ে উঠতে পারবে।
৩৭) ফাস্ট ইলেকট্রনিক্স ও ফাস্ট কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে এই মূহুর্তে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। ওই ঘাটতি পোষাতে এখন আমরা বহু ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করি জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলি থেকে। কিন্তু এ বার যদি আমরা ‘সার্ন’-এর দৌলতে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটিং ব্যবস্থাকে অন্তত ১০ গুণ দ্রুততর করে তুলতে পারি ‘গ্রিড কম্পিউটিং’ ব্যবস্থার মাধ্যমে আর তার ফলে যদি আমরা অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বেরিয়ে আসা কণাগুলির চলাচলের পথটাকে এক সেকেন্ডের এক কোটি ভাগেরও কম সময়ের মধ্যে দেখার প্রযুক্তি অর্জন করতে পারি, তা হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সিগন্যাল পাঠানোর গতি অনেকটাই বেড়ে যাবে।
ভাইরাস রুখতে হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ
৩৮) যার ফলে, বিমান চলাচল দ্রুততর ও আরও বেশি নিরাপদ করা সম্ভব।
৩৯) আরও নিখুঁত করে তোলা যাবে উপগ্রহ-মারফত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আরও কম সময়ে উপগ্রহগুলিকে পাঠানো যাবে কক্ষপথে।
৪০) ফলে, উপগ্রহের জ্বালানিরও সাশ্রয় হবে।
৪১) ওই ‘গ্রিড কম্পিউটিং’ খনিজ পদার্থের সন্ধান, ভূস্তরের পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের পরিমাণ ও পরিবর্তন বোঝা ও সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান করতে বিভিন্ন কক্ষপথে পাঠানো উপগ্রহগুলির কাজকে সহজতর করবে, তাদের পাঠানো ছবি ও তথ্যের মান ও গতি অনেক গুণ বেশি হবে। সেগুলি আরও বেশি নিখুঁত হয়ে উঠতে পারবে।
৪২) ২০১৭ সালে সোলার ফোটোভোল্টেইক সেলের আরও অনেকটাই উন্নতি ঘটবে।
৪৩) বিশেষ করে জৈব ফোটোভোল্টেইক সেল হয়তো ২০১৭ সালেই বাণিজ্যিক ভাবে এসে যাবে বাজারে। আর সেটা হলে তা হবে অপ্রচলিত শক্তি-ক্ষেত্রে কার্যত, একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই ক্ষেত্রে দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে পুণের ‘আইসার’ ও ন্যাশনাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি।
জিন এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে বিপ্লব
৪৪) এই ২০১৭ সালেই কাজ চালানোর মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়ে যেতে পারে। এখন পাঁচ কিউ-বিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার আইবিএমে চলছে। কিন্তু সেই পাঁচ কিউ-বিট দিয়ে বিশেষ কিছু করা যায় না। তাকে বড় করার প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। ২০১৭ সালে এ ক্ষেত্রে বড় কোনও ‘ব্রেক-থ্রু’ হতেই পারে। এই ক্ষেত্রে ভারতে রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের (টিআইএফআর) কাজ।
৪৫) ‘নিউরো-সায়েন্সের গবেষণা বেসিক রিসার্চের গণ্ডি পেরিয়ে আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়বে ক্লিনিক্যাল রেলিভ্যান্সের দিকে।
৪৬) অনেক মানসিক রোগের নতুন নতুন ওষুধ বের করতে পারব আমরা, ২০১৭-য়।
৪৭) সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাটি হতে পারে, বার্ধক্যের গতিকে কিছুটা হলেও রুখে দেওয়ার কোনও ওষুধ বা কোনও চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার হতে পারে। বার্ধক্যের গতিকে যে চাইলে আমরা কিছুটা হলেও কমিয়ে দিতে পারি, ইতিমধ্যেই তা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। তার ব্যবহারিক প্রয়োগের উপায়ও হয়তো এ বার আমাদের হাতে এসে যাবে। পারকিনসন্স ডিজিজের কোনও অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কারেরও জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে আগামী বছর।
৪৮) আমাদের শরীরের কোষগুলিতে ময়লা সরানো ও পুনর্ব্যবহারের জন্য ‘প্রোটিয়াসোম’ নামে একটি পদার্থ রয়েছে, যা কি না কোষের মধ্যে জমে থাকা গলদে ভরা প্রোটিনকে বিদায় করে দিয়ে কোষগুলিকে সুস্থ রাখে। ২০১৬ সালেই প্রথম জানা গিয়েছে, একটি উৎসেচক বা এনজাইম ওই প্রোটিয়াসোমের কাজের গতি বাড়িয়ে দিতে পারে। কাজেই মস্তিস্কের যে সব রোগ গলদে ভরা বাড়তি প্রোটিন জমে থাকার জন্য হয়, (পারকিনসন্স, হান্টিংটন্স ডিজিজ, ফ্রন্ট-টেমপোরাল ডিজেনারেশন এবং এএলএস) তাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনও নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে ২০১৭-য়।
৪৯) শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার জন্য কি মস্তিষ্কের ‘গ্লিয়া’ কোষগুলি দায়ী? ২০১৬-য় জানা গিয়েছে, ইনসুলিন এই নিষ্ক্রিয় ‘গ্লিয়া’ কোষগুলির উপরে কাজ করে মস্তিস্কে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই কোষগুলিই খিদে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এও দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের শিশু ‘গ্লিয়া’ কোষগুলিকে পূর্ণবয়স্ক হতে বাধা দিলে মস্তিষ্ক থেকে লেপটিন হরমোন না পাওয়ার জন্য শরীরে প্রচুর পরিমাণে মেদ জমা হয়। কাজেই শরীরের ওজন কমানোর চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ বার ২০১৭-য় ‘গ্লিয়া’ কোষের নিয়ন্ত্রণ একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
৫০) প্রোটিন অণুর গঠন-কাঠামো বুঝতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি। যা শুধুই বড় চেহারার প্রোটিন অণু বা প্রোটিনঘটিত জটিল যৌগ অণুগুলির গঠন-কাঠামোর বিশ্লেষণ করে থেমে থাকবে না, খুব ছোট প্রোটিন অণুগুলিরও গঠন-কাঠামোর হদিশ দিতে পারবে আমাদের। আর সেই ছবি হবে অনেক বেশি নিখুঁত। যা ছোট প্রোটিন অণুগুলিকে আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। ২০১৭-য় এটা একটা বৈপ্লবিক ঘটনা হবে প্রোটিন অণু সংক্রান্ত গবেষণায়।
৫১) এটা এক্স রে’ ক্রিস্টালোগ্রাফির একটি ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেত পারবে। শুধু তাই নয়, এক্স রে’ ক্রিস্টালোগ্রাফির অসুবিধাগুলিকেও দূর করতে পারবে। কী ভাবে প্রোটিনগুলিকে বেঁধে রাখা হয়, এর ফলে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন ওষুধের অণুগুলির কাজকর্ম বুঝে ফেলাটা অনেক বেশি সহজ হবে।
৫২) সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে একটি দিকনির্দেশক ভূমিকা নিতে পারে ২০১৭। ৯৯ শতাংশ সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের জন্যই দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি)। ওই ভাইরাসের প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অনেক অগ্রগতি ঘটলেও, খুব সামান্য মানুষের কাছেই তার সুফল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ বার যে সেল্ফ-অ্যাডমিনিস্টার্ড এইচপিভি টেস্ট কিট বেরিয়েছে, তা ২০১৭-য় গোটা বিশ্বেই একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে।
৫৩) ‘সিওয়াইডি-টিডিভি’ বা ‘ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া’ নামে ডেঙ্গির একটি টিকা ইতিমধ্যেই বাজারে এসেছে। ডেঙ্গির আরও নতুন কিছু টিকা বাজারে আসতে চলেছে ২০১৭-য়।
৫৪) কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির গবেষণার পালে হাওয়া লাগবে। যেগুলি মানুষের স্টেম সেল বা ইনডিউসড-প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল থেকে বানানো হয়েছে, বানানো হচ্ছে। সেগুলি ফুসফুস, লিভার, ব্রেন এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের বিভিন্ন ছোট ছোট অংশ। এগুলিকে বলা হয় ‘মিনি অরগ্যানস’ বা ‘অরগ্যানয়েডস’। এই গবেষণা ২০১৭ সালে অনেক বেশি গতি পাবে।
৫৫) এর ফলে, নতুন নতুন ওষুধ তৈরির পথটা অনেক বেশি প্রশস্ত হয়ে যাবে।
৫৬) প্রোটিন অণুর গঠন-কাঠামো বুঝতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে ইন ভাইভো ক্রিস্টালোগ্রাফি।
৫৭) কোল্ড অ্যাটম সংক্রান্ত গবেষণা নতুন একটি মাত্রা পাবে। নাসা মহাকাশে ওই পরীক্ষার জন্য একটি অভিযান শুরু করবে অগস্টে। যার প্রোজেক্ট ম্যানেজার এক জন বাঙালি মহিলা। অনিতা সেনগুপ্ত।
৫৮) ইসরোর পরবর্তী বড় রকমের মহাকাশ অভিযান ‘পোলিক্স মিশন’-এর যন্ত্রাংশ নির্মাণ ও তার পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ আরও গতি পাবে।
৫৯) ১০ লক্ষ বা তার বেশি জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে, ভারতের ভূকম্পপ্রবণ এমন ৪০টি শহরের মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু হবে ২০১৭-য়।
৬০) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভূকম্পপ্রবণ এলাকাগুলিতে আপৎকালীন যে যে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, তা গ্রহণের তোড়জোড়, তৎপরতা শুরু হবে জোর কদমে।
৬১) কলকাতা মেগাসিটিতে ভূকম্পের আশঙ্কা কতটা, কোথায় কোথায় তা কতটা তীব্র হতে পারে, তার জরিপ করা শুরু হবে।