ইতিহাস বলে, একটি শক্তিশালী জাতির প্রভাব, তার সংস্পর্শে আসা দুর্বল জাতির মানুষের ওপর সবসময় পড়ে থাকে। সে প্রভাব যেমন শিক্ষায়, শিল্পে, স্থাপত্যে, জীবনযাত্রায়— তেমনই ভ্রমণে, খেলাধূলায়, পোশাক-আশাকে এবং খাওয়াদাওয়ায়। ফলে ইংরিজি শেখা, কোট-প্যান্ট পরা, কাঁটা-চামচধারী বাঙালি, আস্তে আস্তে রসগোল্লা ও কাঁচা আমের শরবত-স্নিগ্ধ পয়লা বৈশাখের বদলে, এক সময় কেক-প্যাটির ফার্স্ট জানুয়ারিকেই নিজেদের সাল পয়লা বলে মেনে নিল। একমাত্র বিধবা ঠাকুমা-পিসিমাদের একাদশী-অমাবস্যা আর পূর্ণিমার চাঁদটি দেখিয়ে দেওয়া ছাড়া, বাংলা ক্যালেন্ডারের আর কোনও ফাংশনই রইল না। বিদেশি কালচারের দেখাদেখি নিজের কাছে অথবা নিজের প্রিয় মানুষদের কাছে, সে নতুন ইংরিজি বছর-জুড়ে পালন করবে— এমন কিছু অঙ্গীকার করাও শুরু করল। কেউ হয়তো প্রেমিকার কাছে শপথ নিল— নতুন বছরে একটা ভাল চাকরি জোগাড় করবেই করবে। কেউ হয়তো নিজের স্ত্রীকে কথা দিল— ১ তারিখ থেকে তাকে আর রেসের মাঠের ধারেকাছেও দেখতে পাওয়া যাবে না । আবার কেউ হয়তো ৩১ ডিসেম্বর রাত্তিরে নিজের প্রিয় সিগারেটে শেষবারের মতো টান দিয়ে, স্ব-ইচ্ছায় গোটা প্যাকেটটা সাঁ করে ছুড়ে দিল মফস্সলের কুয়াশা-ঘেরা পুকুরের ঠান্ডা জলে। এই সমস্ত অঙ্গীকার শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা সম্ভব হয়, কি হয় না— সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু অঙ্গীকার তো অঙ্গীকার!
আরও পড়ুন, ১০০ টাকার ফার্স্ট জানুয়ারিতে আইসক্রিম আর ফুচকা…
আমার খুব ইচ্ছে, এ বছরের শেষ রাত্রে, আমি আমার আড়াই ইঞ্চির ছোট্ট জিভখানার জন্যে এমনই এক জুতসই অঙ্গীকার করব— যেমন অঙ্গীকার ম্যারিয়্যানের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে করেছিলেন শেরউড বনের বিখ্যাত তিরন্দাজ রবিন হুড। ইচ্ছে হয় প্যাপিরাসের পাতার ওপর খাগের কলম দিয়ে লিখে দিই একটি অঙ্গীকারপত্র। যাতে লেখা থাকবে— বছরের প্রথম দিনটি থেকে কচি কলাগাছের আঙট-পাতার মতো আমার জিভের পাতাটি, কেবল হরেকরকম নতুন খাবারের স্বাদে ভরে উঠবে। এমন একটি পদও তার স্বাদকোরকগুলিকে স্পর্শ করবে না, যা সে আগে চেখেছে। এই ভাবে আমি হয়তো আমার জন্মইস্তক চেনা রসনাটিকে আরও একবার চিনে নেব। জেনে নেব স্বাদের নতুন কোনও এক জগত। হয়তো অন্যের বহুবার খাওয়া, বহু আলোচিত একটি পদকেই নিজের নবতম আবিষ্কার বলে ভেবে নেব মনে মনে... কিন্তু তাতে আর কীই বা আসে যায় এ বিশ্ব সংসারের! কী-ই বা আসে যায় কাঁঠালগাছের পাতার ফাঁকে বসে এক মনে ডেকে চলা বসন্তবউরি পাখিটির!
আসলে প্রতি দিন আমরা যে শাক-সব্জি-মাছ-মাংস বাজারে দেখি তার রন্ধনপ্রণালীর চেনা ছকটিকে একটু ওলোট-পালোট করে দিলেই তো বেশ কিছু অচেনা রেসিপি বেরিয়ে আসে । যেমন ধরুন, অতি চেনা ছোট্ট ছোট্ট কাচকি মাছগুলিকে ঝকঝকে দেখে কিনে এনে-- বেছে, ধুয়ে-- পেঁয়াজবাটা, রসুনবাটা, মরিচ, হলুদ, ফেটানো ডিম ও কর্নফ্লাওয়ারের গুঁড়ো দিয়ে ভাল ভাবে মেখে, বল বানিয়ে, ডুবো তেলে ভেজে নেওয়া গেল। তারপর আলাদা করে পেঁয়াজ ও পেঁয়াজকলি কুচি, রসুনকুচি, ক্যাপসিকাম কুচি আর টম্যাটো কুচি সাদা তেলে ভেজে নিয়ে, তার সঙ্গে সয়া সস, সাদা ভিনিগার ও কর্নফ্লাওয়ার গোলা দিয়ে একটি গ্রেভি বানিয়ে, তাতে বলগুলি ফেলে ফুটিয়ে নেওয়া হল । এ বার এই পদটিকে যদি কাচকি-মাঞ্চুরিয়ান বলে ডাকি, তা হলে কি আপনাদের আপত্তি হবে?
আবার ধনেপাতা, পালং শাক, বাড়িতে বানানো ছানা, কাজুবাদামের গুঁড়ো, লঙ্কা ও আদাবাটা আর চাট মশলা দিয়ে মাখা ময়দা দিয়ে বানানো মুচমুচে গরম একটি পরোটা তৈরি করা যেতেই পারে— যার রংটি হবে বৃষ্টিভেজা কেরলের ব্যাকওয়াটারের ধারে ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ-গাছালির মতো স্নিগ্ধ সবুজ। এই পরোটাটি দিয়ে থকথকে আমতেলের আচার যেন ইহুদি মেনুহিন আর রবিশঙ্কর।
রঙিন ক্যাপসিকাম তো এই শীতেই বেশি ওঠে। ছোট ছোট কতকগুলি টুকটুকে লাল ক্যাপসিকাম বেছে নিয়ে, অর্ধেক কেটে, দু-ধারের দু’টি টুকরোর পেটের ভেতরটা ভাল ভাবে পরিষ্কার করে, হালকা ভাপিয়ে নিয়ে, সেখানে পেঁয়াজ-রসুন-আদা-লঙ্কাকুচি দিয়ে কষে নেওয়া খাসির কিমার পুর ঠেসে সবসুদ্ধু মিনিট দশেক বেক করে নিতে হবে। তবে বেক করতে ঢোকানোর আগে পুরো ক্যাপসিকামটির গা-জুড়ে সামান্য তরল চিজ লেপে দিতে পারলে খুবই ভাল হয়। এতে ক্যাপসিকামের গা একেবারে তুলতুলে নরম হয়ে যাবে।
শীতের দেশি ফুলকপি বাজারে ভরে গিয়েছে। উঁহু, বড় কচকচে গোল স্নো-বলের কথা বলছি না কিন্তু। ফুলটা ছোটো। আর ওপরটা সামান্য ফ্ল্যাট হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এমন কপি হাতে নিলে কোনও রকম গুমসুনি গন্ধ পাওয়া যাবে না। সকাল ছ’টা নাগাদ লোকাল বাজারে যখন আসে, তখন এদের মাথার ওপরটা শিশির পড়ে ঠান্ডা আর ভিজেভিজে থাকে। মনে হয় সদ্য স্নান সেরে ও যেন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ছাদে উঠে এসেছে। এমন কপি ডুমোডুমো করে কেটে, নরম করে ভেজে, রেওয়াজি খাসির কালিয়ায় ফেলে কষে, সেদ্ধ বাসমতী চালের ঝরঝরে গরম ভাত দিয়ে খেতে হয়। সেদ্ধ বাসমতী লম্বা এবং ফুরফুরে। কিন্তু এর নিজস্ব কোনও গন্ধ নেই। এদের স্বভাব অনেকটা শ্রদ্ধেয় রাধাকান্ত নন্দীর মতো। মানে, উনি একটি গানের তাল নিয়ে নানা রকম খেলা করে তবলা বাজাচ্ছেন-- কিন্তু গানের মেজাজকে ক্ষুন্ন হতে দিচ্ছেন না বা গায়ককে বিন্দুমাত্র অস্বস্তিতে ফেলছেন না। তেমনই চালটি সুগন্ধী হলে কিন্তু কপি ও মাংসের আসল মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যেত।
হঠাৎ সকালবেলা বাজারে গিয়ে হয়তো দেখলেন, একটি বড়ো সাইজের সাদাটে হর্স ম্যাকারেল বা পারামাছ এসেছে— যা চোখের সামনে কেটে কেটে ফিলের মতো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এর মোটাসোটা ও চওড়া শিরদাঁড়াটির গায়ে প্রচুর মাংস লেগে থাকে। বেশ খানিকটা শিরদাঁড়া, দরদাম করে কিনে, ইঞ্চি তিনেকের মতো করে পিস করিয়ে আনুন। ভাল ভাবে গরম জলে ধুয়ে গায়ে সামান্য মাখন মাখিয়ে ননস্টিক প্যানে থান-পাউরুটির মতো এপিঠ-ওপিঠ সেঁকতে শুরু করুন। হাতের কাছে রাখুন ভাল মধু, পুদিনাপাতা বাটা, ধনেপাতা বাটা, মরিচগুঁড়ো, নুন, পেঁয়াজের রস ইত্যাদি। মাঝে মাঝে ওগুলিকে ওই টুকরোগুলির গায়ে ঘষে দিতে থাকুন এবং তাওয়ার ওপর কাঁটাটিকে উল্টে-পাল্টে দিন। এই সময় তালাত মামুদের কোনও পুরনো বাংলা ক্যাসেট থাকলে পরিবেশটা আরও ভাল হবে। হাড়ে লেগে থাকা মাংসে বাদামি ছোপ ধরতে শুরু করলে, কাঁটার ডগা দিয়ে একটু খুচিয়ে দেখে নিয়ে তবেই নামান। পরিবেশন করুন কড়া টোস্ট এবং ফ্রেশ স্যালাডের সঙ্গে। শিরদাঁড়ার হাড়টি শেষকালে ভেঙে ওর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুস্বাদু স্নায়ুরজ্জুটি চুষে খেতে যেন ভুলবেন না। খাওয়া শেষ হলে ঠিক ২৩ মিনিটের মাথায় এক কাপ কালো কফি খান। যদি খারাপ লাগে আমার বাড়িতে এসে গুনে গুনে ১৩টি কিল মেরে যাবেন— আমি হাসিমুখে খাব।
শীতের বাজারে গায়ে রোঁয়া ওঠা মাচার পটল আসে। এমন পটল মাঝারি সাইজের পেয়ে গেলে নিয়ে নিন। সঙ্গে নিন কিছুটা টাটকা কাতলামাছের ডিম। পটলগুলোকে লম্বালম্বি দু-চেলা করে চিরে ফেলুন। পেটের মধ্যের শাঁস-সহ দানা ফেলে দিন । মাছের ডিমটিকে পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কাবাটা-নুন-মিষ্টি দিয়ে অল্প তেলে ভেজে, তাতে অল্প টকদই মিশিয়ে কিছুক্ষণ পরেই নামিয়ে নিন । তারপর পটলগুলির পেঁটের খাঁজে তা লেপে দিয়ে, ননস্টিক প্যানের মধ্যে আলাদা ভাবে পোস্ত ও সরষে দিয়ে একটি মাখা মাখা গ্রেভি বানিয়ে তার মধ্যে ওই ভাজা পটলগুলিকে সোজা করে বসিয়ে ঢাকা দিয়ে দিন। এই পদটিকে আমাদের বাড়িতে ‘ডিম-পটলের-নৌকা’ নামে ডাকা হত, যা গরম সাদা ভাতের সঙ্গে চমৎকার।
দেশি আমড়ার ছাল ছাড়িয়ে ভাল ভাবে ছেঁচে নিয়ে, তাতে চিনি আর দানাদার পোস্তবাটা দিয়ে একটি চমৎকার চাটনি হতে পারে। এই চাটনিটি ঠান্ডা ভাতের সঙ্গে খেতে ভারি ভাল লাগে। আরও একটি ফল আসে শীতের ঠিক আগে এর নাম টক ঢেঁড়স, আবার কোথাও কোথাও এর নাম চুকাই। লালচে বেগুনি রঙের একটি ফুলের মতোই দেখতে একে। মুশমুশে মতো ভেতরটায় ছোট দানা থাকে। একে ঘন চিনির রসের মধ্যে ফুটিয়ে একটি দারুণ চাটনি তৈরি করা যায়। করা যায় এর টক-মিষ্টি জেলি। রসটা চেটে খেয়ে , ফলটা চিবিয়ে খেতে ফ্যান্টাসটিক। কখনও এই চুকাইয়ের জেলিকে সাদা ভ্যানিলা আইসক্রিমের ওপরে ছড়িয়ে খেয়ে দেখবেন-- কী অসাধারণ!