সময়টা নব্বুইয়ের দশক। দু’হাতে দু’টো বড় ব্যাগ ভর্তি বিছানার চাদর নিয়ে বাড়ি-বাড়ি ফেরি করতেন সমিতা চট্টোপাধ্যায়। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন চাদর ছাপার মস্ত কারখানা খুলবেন। সমিতাদেবীর স্বপ্নের কথা শুনে তখন হাসতেন অনেকে। বাড়ির বউ পথে নেমেছে বলে কটূক্তিও শুনতে হয়েছে। কিন্তু সমিতাদেবী পাশে পেয়েছিলেন তাঁর স্বামী রতন চট্টোপাধ্যায়কে। স্রেফ মনের জোর আর কঠোর পরিশ্রমের ফসল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ঝাড়গ্রাম শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে। ৮ বিঘে বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে সমিতাদেবীর স্বপ্নের ‘টেক্সপ্রিন্ট’। অরণ্যশহরের এই কারখানায় আটটি স্তর পেরিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের উত্কৃষ্ট মানের প্রিন্টেড বিছানার চাদর ও বালিশের কভার। সেই সব প্রিন্টেড চাদর পৌঁছে যায় দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। একসময় সংসার চালাতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে সমিতাদেবীকে। আর আজ তাঁর কারখানার দৌলতে কয়েকশো শ্রমিক ও কর্মীর অন্নসংস্থান হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক সমিতাদেবীর এই সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। পেয়েছেন সেরা মহিলা শিল্পোদ্যোগীর পুরস্কার। কোনও রকম ব্যাঙ্ক ঋণ ছাড়াই ব্যবসায় লাভের পুঁজি দিয়েই সমিতাদেবী গড়ে তুলেছেন এক বড় মাপের চাদর ছাপার শিল্প।
এক সময় সংসারে অনেক ঝড়ঝাপ্টা পোহাতে হয়েছে। তখন স্বামীর সামান্য ব্যবসা। সমিতাদেবী ঠিক করেন তিনি নিজে কিছু করবেন। গুজরাতে টেক্সটাইল ডিজাইনার এক ভাসুরের সাহায্যে ১৯৮৯ সালে ঝাড়গ্রামে ঘরোয়া পদ্ধতিতে চাদর প্রিন্টের কাজ শুরু করলেন। গুলিসুতোর কাপড় কিনে এনে নিজের হাতে স্ক্রিন প্রিন্ট করতেন। তারপর ব্যাগ ভর্তি সেই চাদর নিয়ে ঝাড়গ্রাম শহরের পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করে বিক্রি করতেন। এ ভাবেই পরিচিতি শুরু হল। তখন সারা দিনে মেরেকেটে ৬ পিস চাদর প্রিন্ট করা হতো। ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে কলকাতার মহাজনদের কাছে চাদর বিক্রি করতে শুরু করলেন। চাদর বিক্রি করে জমানো পুঁজি দিয়ে অল্প অল্প করে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হল। নানা ধরনের নিত্য নতুন অভিনব ডিজাইনের ফলে ক্রমে সমিতাদেবীর চাদরের কদর বাড়তে শুরু করল। গুজরাটের টেক্সটাইল মিল দেখে এসে ঝাড়গ্রামে নিজের পরিকল্পনায় মিস্ত্রি দিয়ে খুবই স্বল্প খরচে একের পর এক যন্ত্র তৈরি করলেন।
আরও বেশি সংখ্যায় চাদর প্রিন্ট শুরু হল। বড়বাজারের আড়তদাররা ঝাড়গ্রামে এসে চাদর নিয়ে যেতে শুরু করলেন। এখন সমিতাদেবীর চাদর নিয়মিত কিনছে রাজ্য সরকারি সংস্থা তন্তুজ ও বঙ্গশ্রী। এ ছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় চাদরের বাজার পাণিপথের মাণ্ডিতেও সমিতাদেবীর কারখানার চাদরের বিপুল চাহিদা রয়েছে। নরম টেকসই কাপড়ের উপর রঙবেরঙের নকশা। এখন প্রতিদিন কয়েক হাজার চাদর প্রিন্ট হয় তাঁর কারখানায়। নিজের কারখানা চত্বরের মধ্যেই একটি বাড়ির দোতলায় স্বামী, ছেলে, বৌমা ও ছোট্ট ফুটফুটে নাতনি নন্দিনীকে নিয়ে থাকেন সমিতাদেবী। কারখানা চত্বরেই রয়েছে তাঁর চাদরের একমাত্র খুচরো বিক্রয় কেন্দ্র। কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৪ লক্ষ টাকা খরচ করে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও বসানো হয়েছে। কারখানার যাবতীয় বর্জ্যজল পরিশোধন করে তারপর পুরসভার নালায় ছাড়া হয়। সমিতাদেবীর কথায়, “একসময় ব্যাঙ্ক লোনের জন্য বহু ঘুরে জুতোর সুকতলা খুইয়ে ফেলছিলাম। তখনই ঠিক করেছিলাম, নিজের চেষ্টায় লোন ছাড়াই প্রতিষ্ঠান গড়ে সবাইকে দেখিয়ে দেব। সেটা করে দেখাতে পেরেছি।”
কারখানার কর্মী পিঙ্কি মজুমদার, শুভা গাঁতাইত, জয়ন্ত মাহাতো, ভূষণচন্দ্র মাহাতোরা বলেন, “মালকিনের কোনও ক্লান্তি নেই। এখনও সব কিছু নিজে তদারক করেন।”
১৯৯৬ সালে ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর (ফসমি) তরফে শ্রেষ্ঠ মহিলা শিল্পোদ্যোগীর সম্মান পেয়েছেন তত্কালীন রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডির হাত থেকে। অরণ্যশহরে একটি যোগাসন কেন্দ্রও চালান সমিতাদেবী। বয়স্ক ক্রীড়াবিদ হিসেবেও নামডাক রয়েছে তাঁর। সারা বছর নানা ধরনের সমাজসেবাও করেন।
সমিতাদেবীর কথায়, “বাঙালি মেয়েরা শিল্প গড়তে পারে না, এই অপবাদ আমি ঘুচিয়ে দিয়েছি। লক্ষ্য স্থির রেখে সত্ভাবে সত্যের পথে থেকে কাজ করে যেতে হবে। সমালোচনায় কান দেওয়া চলবে না। তাহলে সাফল্য আসবেই।”