ইস্কুলে থাকতে সব্বাই পড়েছে নিউটনের তৃতীয় সূত্র। যে কোনও ক্রিয়ার একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। সমাজেও সবই কোনও না কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনন্ত জটাজাল, যার কিছু ইতি এবং কিছু নেতি। কার কাছে কোনটা কী, সেটাই যা আলাদা!
মৈনাক ভৌমিকের ‘টেক ওয়ান’ এমনই একটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গল্প বলবে বলে কথা দিয়েছিল। একটি লিক হয়ে যাওয়া সিনেমা-ক্লিপিং এবং তার প্রতিক্রিয়া। দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলুম, ছবিটা একটি ক্লিপিং এবং তার প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। মানে ক্লিপিং-এর প্রতিক্রিয়ায় কী কী ঘটল সেটা যত না আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় নায়িকার বিপর্যস্ত মুখ।
ক্লিপিং সর্বস্ব আলোচনা যে মানসিকতা থেকে আসে, ছবিটা যেহেতু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাই তথাকথিত সাহসী দৃশ্যের কথায় পরে আসছি। আগে প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় আসি।
শুরু থেকে শেষ ইস্তক মেলানকোলিক, অ্যালকোহলিক দোয়েল মিত্র গুমরোচ্ছেন আর চোখের জল ফেলছেন। টুকরোটাকরা সংলাপে শুনছি, ইন্ডাস্ট্রিতে নাকি খুব শোরগোল চলছে। ছবির প্রোমোশন থেকে নাকি বাদ পড়ছেন দোয়েল। যে ছবির শু্যটিং চলছে, তার পরিচালক আড়ালে খিস্তি মেরে ভূত ভাগাচ্ছেন (সেন্সর বোর্ড বড়ই উদার)। টিভির পর্দায় পাঁচ পাবলিক পাঁচ কথা কইছে।
কিন্তু তাতে দোয়েলের কী এমন ক্ষতি? এমন দৃশ্য তো নেই যে, দোয়েল শু্যটিং ফ্লোরে গিয়ে শুনতে পেলেন পরিচালক গালাগালি দিচ্ছেন বা তাঁকে ছবি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে! এমন দৃশ্য নেই যে, দোয়েলের পরিচারক-ড্রাইভার-হেয়ার ড্রেসাররা তাঁকে নিয়ে কানাকানি করছেন! এমনকী বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গেও তাঁর এই নিয়ে কোনও ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে বলে দেখানো হয়নি। এটা ঠিক যে দোয়েলের মেয়ের উপরে পাছে এ সবের প্রভাব পড়ে, এই আশঙ্কায় তাকে সরিয়ে নিলেন তার ঠাকুমা। কিন্তু দোয়েলকে তার মেয়ের মুখেও ক্লিপিং নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হল বা তার মেয়ে সত্যিই ইস্কুলে গিয়ে ঝামেলায় পড়ল, এমন ঘটনা নেই। একমাত্র পর্নো ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পাওয়া ছাড়া দোয়েল নিজে সরাসরি কী ভাবে হেনস্থা হলেন, সেটা কোত্থাও নেই। ফলে দোয়েল মিত্রর গল্প দুখিনী নায়িকার একঘেয়ে জীবনের টেক ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর...। ক্লিপিং স্ক্যান্ডালে বিধ্বস্ত নায়িকার গল্প না।
তার মধ্যে আবার প্রেমঘটিত সমস্যা। যে কেঠো বয়ফ্রেন্ডকে দেখলে এমনিই কুলোর বাতাস দিতে ইচ্ছে করে, তার জন্য স্বস্তিকা কেঁদে আকুল! বিক্রমজিৎ না চেহারায় পোক্ত, না অভিনয়ে। দোয়েলের জীবনে যৌন চাহিদা মেটানো ছাড়া সে আর কী করে, বোধগম্য নয়। এই এপিসোডটার সঙ্গে ক্লিপিং কেলেঙ্কারির তেমন যোগও নেই। এমন যদি হত যে, ক্লিপিং-বিতর্কে একদা পাশে দাঁড়ানো বয়ফ্রেন্ড নিজে যখন বিট্রে করল, তখন সে-ও ক্লিপিং নিয়ে দু’কথা শুনিয়ে গেল, তা হলে সেটা গল্পে একটা মাত্রা জুড়ত। সে সব ভোঁ ভাঁ!
অথচ নারীপ্রধান গল্প, যৌনতা ইত্যাদি মৈনাকের প্রিয় বিষয়। এর আগে একাধিক ছবিতে চমকে দেওয়ার মতো কিছু মুহূর্ত তৈরি হতে দেখেছি তাঁর ছবিতে। ভেবেছিলাম ‘টেক ওয়ান’য়ের মতো সাবজেক্ট পেয়ে তিনি অনায়াসে ছক্কা হাঁকাবেন। কিন্তু হতাশ হতে হল। সমাজে নানা রকম হিপোক্রেসি আছে, এটা কোনও নতুন কথা নয়! কিন্তু সেই হিপোক্রেসির এমন কোনও মোচড় ছবিতে এল না, যা নতুন করে শিউরে উঠতে বাধ্য করবে। এমন কোনও পরত খুলল না, যা আলাদা করে ভাবিয়ে তুলবে। বরং ভণ্ড সমাজ, ভিক্টিম নায়িকা আর বিবেকী সাংবাদিকের সরল, একপেশে ত্রিকোণ বাসি তরকারির মতো বিস্বাদ ঠেকল!
পাওনা বলতে পাঁচটা। মা-মেয়ের দৃশ্যগুলো দারুণ ফুরফুরে। স্বস্তিকার মেয়ে অন্বেষাকে ভারি মিষ্টি লাগে। কোনও কোনও মুহূর্তে সে মাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। মা-মেয়ের রসায়নই এ ছবির উজ্জ্বলতম প্রাপ্তি। আর একটা পার্টির দৃশ্য আছে, যেখানে স্বস্তিকা ঈর্ষার আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্পূর্ণার উপরে। আলাদা করে দেখলে একটা সত্যিকার ছাল-চামড়া ছাড়ানো দৃশ্য। আর মুগ্ধ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক ময়ূখ ভৌমিক, চিত্রগ্রাহক গোপী ভগত।
পাঁচের মধ্যে পঞ্চম স্বস্তিকা। তিনি যে কতখানি উজাড় করে দিয়েছেন, সেটা ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে। ‘আই অ্যাম হার মাদার’য়ের অংশটা অনেক দিন মনে থাকবে। এখনও অবধি স্বস্তিকার সেরা কাজ। সেরা কাজ, কিন্তু স্বপ্নের ছবি নয়। গল্পের গাঁথুনিই যেখানে গায়েব, সেখানে অভিনয় কতটা পুষিয়ে দেবে? মেকআপহীন ত্বকের দাগ-ছোপ-ব্রণ চরিত্রের জন্য ভাল। কিন্তু চিত্রনাট্যের ফাটল সর্বক্ষণ হাঁ করে থাকলে সেটা ভাল না।
রাহুলের চরিত্রটাই ধরা যাক! স্ত্রী-পরিত্যক্ত মদ্যপ যুবক। মিডিয়ার সব কেষ্টবিষ্টু যখন ফেল, তখন সে দোয়েলের ইন্টারভিউ নিয়ে ধামাকা লাগিয়ে দেবে! ক্লিপিং-প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকের জন্ম! নিউজ চ্যানেলের সম্পাদকমশাইও রাজি! ওয়ানাবি সাংবাদিক তার বন্ধুকে নিয়ে সটান সম্পাদকের চেম্বারে মাঝে মাঝেই উপস্থিত। একা ফাঁকাই বসে থাকেন সম্পাদক। শুধু পিছনের বোর্ডে লেখা থাকে, ব্রেকিং নিউজ! অহো!
ছবির শুরুতে ইংরিজিতে ঢাউস প্রস্তাবনা। রামায়ণের কাল থেকে নারীর শুচিতা, যৌনতা নিয়ে কী ভীষণ ভণ্ডামি, কী অন্যায়-অবিচার...ইত্যাদি। দর্শককে কতটা নির্বোধ ভাবলে বা নিজের ছবি নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকলে, এ রকম নোট দিতে হয়? সিনেমার কাজ তো মাস্টারি করা নয়! দোয়েলের সঙ্গে সীতার তুলনা যে টানা হচ্ছে, সেটাও লিখে দিতে হল? ছবিটা দেখে বুঝতে পারতাম না?
চোপ, সিরিয়াস চলছে! বহু আলোচিত দৃশ্যে হল-এ প্রগাঢ় স্তব্ধতা। দৃশ্যটা নেহাত ছোট নয়। যতই ‘ব্লার’ করে দেখানো হোক না কেন, স্বস্তিকার সাহস তাতে আড়াল হয় না। আবহে যে সঙ্গীত রয়েছে, সেটা দৃশ্যকে সুড়সুড়িতে পরিণত হতেও দেয় না। এটা নিঃসন্দেহে খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ। এবং মৈনাক উত রেছেন।
তবে পূর্বসুরিরাও আছেন। আশির দশকের শেষ দিকেই নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ‘পরশুরামের কুঠার’ বলে একটা ছবি করেছিলেন। সুবোধ ঘোষের গল্প। মুখ্য চরিত্রটি ছিল এক মহিলার, যিনি ভাড়া করা স্তন্যদায়িনী হিসেবে কাজ করতেন। এই ছবিতে অভিনয় করে শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায় সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পান। স্তন্যপান করানোর দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন নিঃসঙ্কোচে। কিন্তু নব্যেন্দু বা শ্রীলেখা কেউই এই সাহসকে সে আমলে আলাদা করে বিজ্ঞাপিত করার দরকার মনে করেননি। হিপোক্রিসি নিয়ে কেমন ছবি এর আগেও হয়ে গেছে বাংলায় সেটা এই বেলা মনে রাখা ভাল।
‘ছত্রাকে’র ক্ষেত্রে ক্লিপিং লিক হয়ে যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা। তার পর তা নিয়ে যে ধ্যাষ্টামো হল, কোনও ধিক্কারই তার জন্য যথেষ্ট নয়। সিনেমার ম্যাগাজিনগুলোয় সে সময় পাওলির মুণ্ডুপাত করা হয়েছে, তার পাশেই আবার বিতর্কিত ক্লিপ-এর ফ্রেম টু ফ্রেম ছবি ছাপা হয়েছে। নীতি-পুলিশিও রইল, নয়নসুখও রইল!
এই দুমুখোপনাকেই আক্রমণ করার কথা ছিল ‘টেক ওয়ান’য়ে। কিন্তু তা হলে স্বস্তিকার বাছা বাছা ছবিগুলো প্রচারে আনা কেন, সেটা বুঝিনি। পলিটিকাল কারেক্টনেসও রইল, যৌনতার পাবলিসিটিও হল! এটাও কি দুমুখোপনা নয়? সাহসী বিষয় নিয়ে সাহসী ছবি করার সাধুবাদ এবং ছবির গুণগত প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার দুঃখ, দু’টোই রইল। দুমুখো প্রতিক্রিয়া।
পুনশ্চ: ছবিতে দোয়েল মিত্র যখন পুরস্কার পেলেন, বলা হল ভারতীয় অভিনেত্রীর এই প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য। সুচিত্রা সেনকে কি এত দ্রুত ভুলে গেলাম আমরা?