শিলং কালীবাড়ির সঙ্গে যুক্ত সেই ফুটবল নেশাড়ুর কথা সত্তর দশকের মাঝামাঝি কলকাতায় বসেও খুব কানে আসত।
ভারতীয় ফুটবলের হেন বৃত্তান্ত নেই যে তিনি খোঁজ রাখেননি। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় একবার সেন্ট অ্যান্থনি স্কুলকে কোচিং করানোর জন্য একমাস শিলংয়ে। এই বাঙালি ভদ্রলোক প্রথম সুযোগেই পৌঁছে গেলেন পিকে-র কাছে।
“আচ্ছা, রোম অলিম্পিক্সের ওই ম্যাচটায় ইন্ডিয়া ২-১ হারল হাঙ্গারির কাছে। আপনি ক্যাপ্টেন হয়েও সে দিন পেনাল্টি মারেননি কেন?”
পিকে নাকি খুব রুষ্ট হয়েছিলেন। ভদ্রলোকের তাতে কিছু আসে-যায়নি। বহু বছর ধরে প্রশ্নটা মনের মধ্যে পুষছিলেন। প্রথম সুযোগেই কৌতূহলের নিবৃত্তি করেছেন। বেশ করেছেন। এ হেন তিনি ৮২-র বিশ্বকাপ দেখতে স্পেন গেলেন। শিলংয়ের ফুটবল মহল আলোড়িত। ফিরে এসে এ বার তিনি কী না কী বলবেন!
আশ্চর্য! ফিরে আসার পর ভদ্রলোকের মুখই খোলানো গেল না। শত পীড়াপীড়িতেও নয়। বরং বিষাদের সঙ্গে বললেন, “আর একটা কথাও কখনও ফুটবল নিয়ে বলব না। শুনবও না। ছি ছি, কী নিয়ে এত দিন চর্চা করে গিয়েছি।”
ব্রাজিল বিশ্বকাপের গোটা দশেক ম্যাচ দেখার পর কী দেখছি, কী শিখছি নিয়ে লিখতে হবে শুনে তখন শিলংবাসী কাকা-জ্যাঠাদের মুখে শোনা সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল!
সত্যি একটা কথাও বলতে না হলে ভাল। একটা লাইন না লিখতে হলে তো আরওই ভাল।
বিশ্ব ফুটবল ব্রহ্মাণ্ডের স্বাদ পেলে নীরবতাই ভারতীয় আম ফুটবল দর্শকের অবর্থ্য প্রথম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত! এত বছর তার আশেপাশে চলা যাবতীয় ফুটবল কর্মকাণ্ডই অসহনীয় মনে হওয়া উচিত। আমারও ঠিক তাই হচ্ছে। বহু বহু বছর আগে এরিক ফন দানিকেনের লেখা একটা অনূদিত বই পড়েছিলাম। বইটার নাম বাংলায় করা হয়েছিল— দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ!
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া দেখতে বসার তিন মিনিটের মধ্যে মনের নেটওয়ার্ক থেকে নিজের ইনবক্সেই একটা টেক্সট এল— এটা কি গ্রহান্তরের ফুটবল?
এ বার ভেবেছিলাম সাংবাদিক হিসেবে এআইএফএফ প্রধানকে নিজের উপলব্ধির কথা জানালে কেমন হয়! প্রফুল্ল পটেলকে চিঠি লেখাই যায়, কলকাতার এক সাংবাদিক তার প্রথম বিশ্বকাপ দর্শনে কী কী ফারাক খুঁজে পেল।
তারপর মনে হল, যে প্রেসিডেন্ট হাতে ব্রাজিলের সব ক’টা ম্যাচের টিকিট থেকেও পেলের দেশে আসার চেয়ে জুরিখে ফিফা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গোপন বৈঠকে বেশি উৎসাহী (কারণ তা হলে ভারতে টুর্নামেন্ট আনতে সুবিধে হয়। বিশ্বকাপের সময় মেম্বারদের ভিড় বেশি থাকে) তাঁকে চিঠি লিখে কী লাভ?
কোনও চিঠি তাই নয়। কোনও প্রবন্ধ নয়। ডায়েরির ছেঁড়াপাতার মতোই এলোমেলো সাজিয়ে দিলাম নিজের অভিজ্ঞতাগুলো। হর কি পৌরিতে নিজের মনোবাঞ্ছাসমেত কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দেওয়ার মতো। সবাই জানে একটু পরে গিয়েই ওটা ডুবে যাবে জলে। তবু দেয়। হ্যাঁ, একটা তফাত। ওটা মনোবাঞ্ছাসমেত দেওয়া হয়। এটা চরম হতাশ হয়ে— ভারতীয় ফুটবলের নৌকো আগামী পনেরো-কুড়ি বছর ডুবেই থাকবে জেনে!
দেখে প্রথমেই যা মনে হল
১) মনে হল... ফুটবল মাঠে তো ব্রাজিল-জার্মানির কাছে আমরা আট-দশ গোলে পিছিয়ে আছি। কিন্তু সেই ব্যবধানটা কিছুই না।
এক আলোকবর্ষ পিছিয়ে আছি তো ফুটবল চেতনায়। ওই তফাতটা সেই ফোর্থ ডিভিশনে খেলানো চূড়ান্ত একপেশে ম্যাচে রেফারির দুর্দশার মতো। যে নিজের কার্ডে গোল সংখ্যা লিখেছিল। ‘অ্যাপ্রক্স এইট্টিন’। কেন? রেফারি টেন্টে যখন জিজ্ঞেস করা হল, ‘এটা আবার কী? অ্যাপ্রক্সিমেট মানে কী?’ তাঁর ব্যাখ্যা ছিল,
‘স্যর, বারো গোলের পরেও এত হচ্ছিল যেন বৃষ্টির জল। আর গুনতে পারিনি।’
২) মনে হল... গ্রামবাসীদের ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেমন রাজনৈতিক দলগুলো ভোট আদায় করে, তেমনই আমাদের দেশের ফেডারেশন, আমাদের দেশের তারকা প্লেয়ার, আমাদের কোচ, আমাদের বড় ক্লাব— সবাই বহু বছর ধরে তার অগণিত ফুটবলপ্রেমী ভোটারকে বোকা বানিয়েছে। প্রিয় বা প্রফুল্ল-র মতো রাজনীতিক ফুটবলকর্তারা সবচেয়ে দোষী। এঁরা রাজনৈতিক জীবনে সদাব্যস্ত থাকায় ফুটবল প্রশাসনের নেতৃত্ব হবি হিসেবে বারবার নিয়েছেন। সেটা দেশের লক্ষ লক্ষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী সমর্থকদের জন্য ভয়ঙ্কর দ্বিচারিতা! ফুটবলের মতো প্রথমবিশ্বে বন্দিত খেলায় ফুলটাইম প্রশাসক ছাড়া একমাত্র ভিডিয়ো গেমস্-এই জেতা সম্ভব!
৩) মনে হল... বিশেষ করে কলকাতায় আমরা স্কিলের রোম্যান্টিসিজমে আচ্ছন্ন থেকে গোটা বিশ্বে কী ঘটছে চোখ মেলে তাকাইনি। স্কিল-আচ্ছন্নতার মধ্যে কেউ কেউ কানের কাছে বলেছে ফুটবলে আসল হল পাওয়ার। অথচ বহু দিন ধরেই দু’টোর কোনওটাই এককভাবে বিশ্ব ফুটবল নিয়ন্ত্রক নয়। জোহান ক্রুয়েফ সেই চুয়াত্তরে টোটাল ফুটবল শুরু করে দেওয়ার সময় থেকেই ফুটবল হয়ে গিয়েছে গতির খেলা। দমের খেলা। ফিটনেসের খেলা। যেখানে শক্তি ভীমের মতো হওয়ার দরকার নেই। ব্যায়ামবীরও হতে হবে না। কিন্তু কার্ডিও-ভাসকুলার ক্ষমতা চাই অসম্ভব গোটা মাঠ এক গতিতে নব্বই মিনিট উঠে নেমে খেলার মতো। যে যুগে জার্মান গোলকিপার দিব্যি সুইপারের কাজ চালিয়ে দিচ্ছে। যে যুগে ব্রাজিলের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে গোল করছে দু’জন ডিফেন্ডার। সেখানে সব কিছু ভাঙছে। ব্যতিক্রমী হচ্ছে। আর ভারতীয় ফুটবল বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। সে না-শুনতে চায়। না-দেখতে চায়।
৪) মনে হল... আধুনিক ফুটবলে সাফল্যের আসল বীজ লুকিয়ে রয়েছে ঠিক প্রশিক্ষক জোগাড়, উপযুক্ত প্রস্তুতিগ্রহণ এবং দক্ষ ছাত্র বাছাইয়ে। ভারতের যে কোনওটাই নেই। মোহনবাগান ফুটবল অ্যাাকাডেমিতে ঢোকার জন্য কেউ অসম্ভব ব্যগ্র বা আপনার চেনাজানা প্রভাবশালী কারওকে গিয়ে ধরছে বলে কখনও শুনেছেন? ইস্টবেঙ্গল-য়েরটা নিয়েও জনজীবনে কোনও আগ্রহই নেই। পাশাপাশি সাও পাওলো ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ঢোকার প্রাণান্তকর ওয়েটিং লিস্টের কথা শুনছিলাম। ঢুকে একেবারে মিলিটারি জীবন। কিছু ছাত্র বিদ্রোহ করে বেরিয়েও আসে। কিন্তু যারা সুযোগ পায় তারা আইআইটি-তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বা দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্সে ইংলিশে সুযোগ পাওয়ার সমতুল্য! ভারতে সেই চেষ্টাটা আকুলভাবে যিনি করেছিলেন তিনি কোনও ফুটবল প্রশাসক নন, কর্পোরেট জগতের বিখ্যাত মানুষ রুশি মোদী। একেবারে ঠিক রোড ম্যাপটাই নিয়েছিলেন সাও পাওলো অ্যাকাডেমির সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে। মোদীর স্বপ্ন সফল হয়নি, কিন্তু ইতিহাসে থেকে গিয়েছে।
এ বার কী শিখলাম
১) শিখলাম... এআইএফএফ-এর সর্বোচ্চ পদে আনতে হবে অত্যন্ত দক্ষ এবং প্রথম শ্রেণির পেশাদার কোনও প্রশাসক। তারপর প্লেয়ার আপনিই উঠবে। ঠিকঠাক ‘প্রফুল্ল পটেল’ খুঁজতে হবে আগে, তারপর ঠিকঠাক ‘ভাইচুং’রা আপনাই বেরোবে। ঠিক যে অর্থ ফিল্ম ডিরেক্টরস্ মিডিয়াম, তৃতীয় বিশ্বে ফুটবলও তাই। পরিষ্কার অফিশিয়ালস্ মিডিয়াম। কর্মকর্তারা যত স্মার্ট, যত বিচক্ষণ, যত দিশারি হবেন, তত তাঁরা এবড়োখেবড়ো জমি থেকেও ভাল ফসল তুলবেন। ভারতীয় ফুটবলের এই সেক্টরটাতেই সবচেয়ে অমাবস্যা! কলকাতায় হঠাৎ গজানো টিভি চ্যানেল ব্রাজিল থেকে ব্রাঙ্কোকে সপ্তাহখানেকের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আনতে পারে, তাঁরা পারে না। এক এজেন্সি একার কৃতিত্বে মেসিকে আর্জেন্তিনা জাতীয়দল সহ সল্ট লেক স্টেডিয়ামে নামিয়ে দিতে পারে, এআইএফএফ পারে না। এক ঠিকাদার সংস্থার প্রধান বায়ার্ন মিউনিখ-এর ফুল টিম নিয়ে আসতে পারেন, এআইএফএফ পারে না।
২) শিখলাম... অ্যাথলেটিক্সের উপর অসম্ভব গুরুত্ব দেওয়া উচিত ফুটবলে অন্তত ন্যূনতম লড়াই করতে চাইলে। বল নিয়ে ট্রেনিং না-করে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন শুধুই সল্ট লেক স্টেডিয়ামের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ব্যস্ত থাকা উচিত বড় টিমগুলোর। আর যুব দলের মূল দায়িত্বে কোনও ফুটবল কোচ না-রেখে অ্যাথলেটিক্সের কোচ আনা উচিত। ফুটবল কোচ থাকবেন তার তলায়। প্রশাসক হিসেবে কুন্তল রায়ের গুরুত্ব ফুটবল মাঠে হওয়া উচিত সুব্রত ভট্টাচার্যের চেয়ে বেশি! তিনি নামী অ্যাথলেটিক্স কোচ তো কী! ফুটবল এখন প্রথমে অ্যাথলিটদের জন্য। পরে ফুটবলারদের জন্য! দরকার হলে লারু বা লিপাসের মতো বিখাত ট্রেনারদের বেশি টাকা মাসমাইনে দিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনও নিয়মেই আগে ফুল, পরে সার হয় না। আগে সার, তার পর গাছ, তবেই না ফুল।
৩) শিখলাম... ঠিকঠাক প্লেয়ার বাছাই না-হলে এগোনো যাবে না। অমুক তিনটে ছেলেকে ড্রিবল করে রোজ দর্শনীয় গোল করছে এটা কখনও নির্বাচনের প্রথম মাপকাঠি হবে না। দেখতে হবে, তার এই পর্যায়ের ধকল নেওয়ার স্বাস্থ্য আছে কি না। পেশির সেই ফ্লেক্সিবিলিটি আছে কি না। অনেকের পেটানো মাসল ভরা চেহারা। কিন্তু পেশি জড়ানো। তার দ্রুত চোট লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা। গোটা ভারত জুড়ে তাই বাছতে হবে কোন জাতের মধ্যে এই রকম পেশি রয়েছে, যেটা খুব ইলাস্টিক অথচ যার মধ্যে পাওয়ার রয়েছে। পাহাড়ি এলাকার ছেলে বা পাহাড়ি সম্প্রদায়ের নির্বাচনে বাড়তি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। বাংলার নয়। নমুনা ভাইচুং তো নিশ্চয়ই। নমুনা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি-ও। পেশির গঠনটাই এমন যে অবিরত খেলার ধকল নিতে পারে।
৪) আর শিখলাম... ভারতকে বিশ্বকাপে পৌঁছাতে গেলে কলকাতা থেকে ফুটবলের মক্কা সরাতে হবে। কলকাতা এখনও তার অতীত গৌরবে বড় বেশি লালায়িত। সেই কবে বাষট্টির এশিয়াডে সোনা জিতেছিল! তারপর থেকে এত বছরেও বাঙালি তার ফুটবল-অহংকার থেকে বিচ্যুত হতে রাজি নয়। বুঝতেই রাজি নয় যে, ব্রাজিলের ক্লাস ফোর যেমন কোনও দিনই কলকাতার গড়পড়তা ক্লাস টুয়ের মতো কবিতা লিখবে না। তেমনই তার ডিএনএ-তেও ব্রাজিলীয়র মতো ফুটবল ট্যালেন্ট থাকবে না। বাঙালি স্বাস্থ্য তো প্রকৃতিগত ভাবে একেবারেই এ রকম বডি কনট্যাক্ট-হাই স্পিড খেলার পরিপন্থী নয়। আজ না হয় কাল, বাস্তবের মুখোমুখি হতে হবেই বাঙালিকে যে আমার সাত-আটটা প্লেয়ার ইন্ডিয়ান টিমে খেলছে, সেই দিন আর ফিরবে না। ফেরাটা ভারতীয় ফুটবলের পক্ষে কাম্যও হবে না।
সব মিলিয়ে সিস্টেমটাকেই পুরো উপড়ে নতুন করে বসাতে হবে। আমাদের ব্যাকলগ ৪৪-৪৫ বছরের। সত্তর সাল থেকেই আমরা ক্রমাগত ভুল হাইওয়ে ধরে এগিয়েছি। আর এখন এগোতে এগোতে পৌঁছে গিয়েছি নতুন ফুটবল গ্রহে।
ব্রাজিলে বসে শিখলাম, আমাদের ফুটবলই আসলে এখন গ্রহান্তরের! ওটা ঠিকঠাক নভশ্চর খুঁজে এই পৃথিবীতে আর ফিরে আসতে পারবে বলে মনে হয় না!