গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
(অস্ট্রেলিয়া)
ছোটবেলায় তাঁকে ব্যাটিং শেখাতে গিয়ে কোচরা মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছিলেন! ভিক্টোরিয়ার ছোকরাকে দেখানো হয় এক রকম, খেলে আর এক রকম। ডিফেন্স শব্দটা এক কান দিয়ে ঢুকে আর এক কান দিয়ে বেরোয়, আর মাঠে গিয়ে যথারীতি ‘দে ঘুমাকে’! ভিক্টোরিয়ার কোচ গ্রেগ শিফার্ডের কড়া লেকচারেও খুব কাজ হয়নি।
ভাগ্যিস হয়নি! নইলে আইপিএল সেভেনে প্রীতি জিন্টার গালের টোল অত গভীর হত না। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মাথার চুলেও কি অত পাক ধরত? ৪৩ বলে ৯৫, ৩৮ বলে ৯০ সজোড় থাপ্পড় এমএসডির টিমকেই সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয়েছে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি টুর্নামেন্ট হিসেবে যেটাকে দেখা হচ্ছিল, সেই ত্রিদেশীয় সিরিজ ফাইনালে ম্যাক্সের ব্যাট আবার ‘ম্যাড’। ঝড় যদি বিশ্বকাপেও চলে, অবাক হওয়ার থাকবে না।
একে তো বিশ্বযুদ্ধ দেশের মাঠে, ছোট থেকে যে মাঠে ক্রিকেটের বাড়বাড়ন্ত, সেই মেলবোর্নেও নামবেন ম্যাড ম্যাক্স। আর বোলারদের যতই মনে হোক এর অফ বলে কিছু নেই, ব্যাট আর জমির অ্যাঙ্গল কখনওই নব্বই ডিগ্রি হয় না, ফুটওয়ার্ক নেই, ব্যাটসম্যান কোথায়, এ তো পাতি স্লগার— সবই কিন্তু ভুল প্রমাণ হয়ে যেতে পারে। কারণ এত কিছুর পরেও ওয়ান ডে স্ট্রাইক রেট একশো কুড়ির কাছে, টি-টোয়েন্টিতে ওটা ১৬৩।
ডেভিড ওয়ার্নারের এই অন্ধ ভক্ত বিশ্বাস করেন, ঢিকির-ঢিকিরে লাভ নেই। আসল কথা পাওয়ার। যার জোরে অফস্টাম্পের বলও আমি ফেলে দেব মিড উইকেট দিয়ে। ‘টিপিক্যাল ম্যাক্সি ডিসমিসালে’ নেমেই গেলেন তো গেলেন। থেকে গেলে? বিপক্ষের অবস্থাও হবে শিফার্ডদের মতো!
ডেভিড মিলার
(দক্ষিণ আফ্রিকা)
চার বছর আগের এয়ারপোর্টের ছবিটা নিশ্চয়ই এখনও মনে আছে ডেভিড মিলারের। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে হাফসেঞ্চুরিতে লাভ হল না। ওয়ান ডে অভিষেকে ৬০ করে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দলে ঢুকে গেলেন ফাফ দু’প্লেসি।
তিনি নেই।
এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়িতে সে দিন মুখোমুখি চুপচাপ বসেছিলেন অ্যান্ড্রু ও ডেভিড মিলার। বাবা-ছেলে। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের শপথটা হয়তো সে দিনই নেওয়া হয়েছিল। এ বারও টিমে দু’প্লেসি আছেন। কিন্তু এবি ডে’ভিলিয়ার্স বাদে টিম যদি বিপক্ষকে তোবড়ানোর কাজে কাউকে নামায়, তো সেটা কিলার মিলার।
সতেরো বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নামা মিলারের ক্রিকেট মডেলটাই ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টির জন্য তৈরি। বিশেষ করে পাওয়ার প্লে-তে, যেখানে তিনি থাকলে পাঁচ ওভারে নির্ঘাত সত্তর থেকে আশি। শক্তির সঙ্গে টেকনিকটাও আছে। বলগুলোকে তাই নিখুঁত নিশানায় আছড়ে ফেলেন স্টেডিয়ামের ছাদে। হবেই। লোয়ার মিডলে ব্যাটিংটা তো লান্স ক্লুজনারের থেকে শেখা।
গেইলদের বিরুদ্ধে পঞ্জাবের হয়ে যে ইনিংসটা খেলেছিলেন আইপিএল সিক্সে, গুরু ক্লুজনার তা খেলতে পারলে খুশি হতেন। ৩৮ বলে ১০১! এই জানুয়ারিতেই তো দেশের হয়ে পাঁচ নম্বরে নেমে সর্বোচ্চ (১৩০*) স্কোরের মালিকানা জন্টি রোডসের থেকে ছিনিয়ে নিলেন। অফ থেকে অন, যে কোনও শট মেরে দেবেন। ফ্রন্ট আর ব্যাকফুট, দুটোই ভাল। আর ছয়-টয় মারা নিয়ে নিজস্ব একটা থিওরি আছে।
যেটা ‘ভি’-এ পড়বে সেটা গাছে যাবে/ যেটা পড়বে আর্কে, থাকবে না পার্কে!
উমর আকমল
(পাকিস্তান)
জীবনের প্রথম পাঁচ টেস্টে গড় ৫৫। কয়েক মাস পরই টেস্ট টিম থেকে বাদ।
মাঠে ‘ছোটা’ মিয়াঁদাদ। মাঠের বাইরে লাহৌরের ট্র্যাফিক সার্জেন্টের বিরুদ্ধে মিয়াঁদাদের মতোই ‘ব্যাটিং’ আর জাতীয় বিতর্ক।
লর্ডসগেটের পরপরই দেশের সম্মান বাঁচাতে একা লড়লেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬৮ বলে ৭৯। পরে সেই একই ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে স্বার্থপর ব্যাটিংয়ের অভিযোগ তুলল পাকিস্তান, আবার বাদ।
প্রতিভার দৌড় বারবার থমকে দিয়েছে বিতর্ক। পাকিস্তানে বলা হয় জাহির আব্বাস, মিয়াঁদাদ, ইনজামাম, ইউসুফদের পর ব্যাটিংয়ের ব্যাটন যদি কাউকে দিতে হয়, তো সেটা কামরানের ছোট ভাইকে। দাদার মতো উমরও উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। কিন্তু ব্যাটিং দাদার চেয়ে অনেক ভাল। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে মিসবা-ইউনিসের মতো অভিজ্ঞদের ছাড়া পাক ব্যাটিংয়ে ভরসা করার মতো নাম। উপমহাদেশে তো বটেই, যাঁর ব্যাট বিদেশেও সমান সুখী। জলজ্যান্ত প্রমাণ জীবনের প্রথম টেস্ট। যেখানে ডুনেডিনে শেন বন্ডকে পিটিয়ে এসেছিল ১২৯। ওয়ান ডে গড় এখনও ৩৬, খুব খারাপ কি?
কিন্তু বিতর্কের গড়টা আরও বেশি। বিরাট কোহলির চেয়ে দু’বছরের ছোট, অথচ খারাপ ফিটনেসের জন্য মাইনে কাটা যাচ্ছে! তাঁকে নিয়ে আবার সন্দেহ, মিথ্যে চোটের অজুহাতে মাঝে-মাঝে সরে পড়েন। কামরান বাদ পড়লে উমরেরও চোট লাগে।
এত কিছুর পরেও তাঁর ব্যাটিং শো, কপিবুক ও কপিবুকের বাইরের শট বিশ্বকাপেও রাতের ঘুম ওড়াতে পারে বোলারদের।
কোরি অ্যান্ডারসন
(নিউজিল্যান্ড)
তাঁর ব্যাটিং দেখে ক্রিস কেয়ার্নস দুঃখ করেন, যদি ও রকম ব্যাট করতে পারতাম! বিরাট কোহলি ভুলতে পারেন না, অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে তাঁর পরপর মারা ছয়গুলো। আর কোরি অ্যান্ডারসনের কোচ ভুলতে পারেন না ছাত্রের দাঁতে-দাঁত চাপা লড়াই।
চোট। ওজন। ঘরদোর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া। কমফোর্ট জোন ভুলে স্বেচ্ছায় নিজেকে চাপে ফেলা। বয়স মাত্র তেইশ হলে কী হবে, এর মধ্যেই প্রচুর ওঠানামা দেখে ফেলেছেন কোরি।
ব্যাটে শক্তি ছিল, বছরের পর বছর পড়ে থেকে সেই শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছেন। কেন উইলিয়ামসন আর ট্রেন্ট বোল্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন, যাতে স্বাস্থ্য-সচেতন দুই কিউয়ির ফিটনেস রুটিন আয়ত্ত করে ফেলা যায়। কুড়ি কেজি ঝরিয়ে ফেলেছেন।
একটা সময়ে ক্রিকেট বলতে কোরি বুঝতেন নামো আর ঠ্যাঙাও। ওটাগোর বিরুদ্ধে নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টসের হয়ে ১৬৭ তাঁর ধারণাটা বদলে দেয়। কোরি বুঝে যান, ক্রিকেট মানে ছোট ছোট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিরে যাওয়া নয়। উইকেটে পড়ে থেকে বিপক্ষকে পুরো শেষ করে মাঠ ছাড়া। আজ তিনি দেশের মাঠে বিশ্বকাপে টিমের অন্যতম ভরসা।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে তাঁর হাঁটাচলা, আদবকায়দা অন্য এক জনের সঙ্গে খুব মেলে। তিনিও প্রতিভাবান ছিলেন, ওজন একটু বেশি ছিল। কিন্তু দু’জনের জীবন শেষ পর্যন্ত গেল দু’দিকে।
জেসি রাইডার ক্রিকেটে আর নেই। আর কোরি অ্যান্ডারসনকে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স কেনে কোটি কোটিতে, করে যান তিনি ৩৬ বলে সেঞ্চুরি।
এবি ডে’ভিলিয়ার্স
(দক্ষিণ আফ্রিকা)
ইম্প্রোভাইজেশন আর পাওয়ার হিটিংয়ে উপরোক্ত চার জনের ঠাকুরদা! আইপিএল সেভেনে ডেল স্টেইনকে মনে আছে? অফস্টাম্পের বাইরে ঘণ্টায় একশো পঞ্চাশে বল ফেলছেন, অফের দিকে সরে স্কুপে অবিশ্বাস্য ছয় মারছেন এবি। স্টেইন হাসছেন, এক ওভারে তো চব্বিশ উঠল!
দিলশানের দিলস্কুপ। কেপির সুইচ হিট। সহবাগের আপার কাট। এমএসডির হেলিকপ্টার শট। এবি ডে’ভিলিয়ার্সেরটা যে কী, এখনও নাম খুঁজে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্যাপ্টেন যেটা পেসারকে মারেন, মারেন অফে সরে গিয়ে ফাইন লেগ দিয়ে তুলে, মারেন ব’লে ব’লে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩১ বলে সেঞ্চুরির অর্ধেক স্কোরিং শট এসেছে যে ভাবে। বিশ্বকাপে তাঁর সামনে পড়লে উমেশ যাদবদের কী হবে, ঈশ্বরও নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।
তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত। পাওয়ার হিটিং দুনিয়ার অর্ধেকটা এবিডির, বাকি অর্ধেক ম্যাড ম্যাক্স-মিলারদের।
মজার হল, যে ডে’ভিলিয়ার্সের ৩১ বলে সেঞ্চুরি আছে, সেই একই ডে’ভিলিয়ার্সের টেস্টে ২০০ বলে ৩১ নট আউটও আছে। যার মানে, টেকনিকে তিনি একশোয় একশো। যার মানে, তাঁকে বল করা সবচেয়ে কঠিন। ছোট থেকে সমস্ত খেলায় দাপুটে, তাই প্রচণ্ড অ্যাথলেটিক। না, বিশ্বের সর্বকালের সেরার ক্লাবে তিনি পড়েন না। ৯৯.৯৪ গড় বা ১০০ সেঞ্চুরি হয়তো কোনও দিন হবে না। কিন্তু মেসি-রোনাল্ডোদের দুনিয়ার বাইরেও এক-একটা গ্রহ থাকে। যেখানে মেসিরাও সব সময় পৌঁছতে পারেন না। এবিও তেমন।
ক্রিকেটের জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ!