‘বদলাপুর’ মুক্তির কিছু দিন আগের কথা। বরুণ ধবন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন শুধু পেশি দেখানো যদি তাঁর উদ্দেশ্য হত, তা হলে তিনি মডেলিং করতেন। ‘‘আমি মন থেকে বিশ্বাস করি অভিনয় দেখানোর জন্যই অভিনেতা হতে হয়। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে চাই না। আই ওয়ান্ট টু মুভ। আই নিড টু ইমোট,’’ বলেছিলেন বরুণ।
‘বদলাপুর’ দেখে অনেকেই বলছেন বরুণ তাঁর স্বপ্নকে কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত করেছেন। ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’, ‘ম্যয় তেরা হিরো’, ‘হাম্পটি শর্মা কী দুলহনিয়া’র সেই রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজটা ঝেড়ে ফেলে কিছুটা এগিয়ে এসেছেন তিনি।
ছবিতে তিনি হালফিলের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান। স্ত্রী-পুত্রকে হারানোর পর যাঁর বেঁচে থাকার একটাই লক্ষ্য। প্রতিহিংসা। খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে।
প্রতিহিংসাকে থিম হিসেবে গত বছর আরও একটা ছবি হয়েছিল। নাম ‘এক ভিলেন’। যার অন্যতম মুখ্য চরিত্রে ছিলেন ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ ছবিতে বরুণের সহ-অভিনেতা সিদ্ধার্থ মলহোত্র। মোহিত সুরির পরিচালনায় তৈরি হয়েছিল এই ছবি। ছবিতে স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিহিংসা নিতে উদ্গ্রীব সিদ্ধার্থ। এক সময় ছিলেন গ্যাংস্টার। প্রেমে পড়ে অন্য ‘গলিয়াঁ’ দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। পাল্টে যান। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার তিনি ফিরে যান পুরনো অবতারে। মাথায় রক্ত। লক্ষ্য একটাই।
খুঁজে বের করতেই হবে তাঁর স্ত্রীর খুনিকে! তিনিও হাঁটতে থাকেন বদলা নেওয়ার রাস্তায়।
বরুণ আর সিদ্ধার্থ। দু’জনেই ভেঙেছেন নিজেদের। অনেকেই বলছেন বলিউডের ধোনি-শিখর ধবন যদি রণবীর কপূর-রণবীর সিংহ হন, তবে এই প্রজন্মের বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা হলেন বরুণ আর সিদ্ধার্থই। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে কে বেশি এগিয়ে?
‘বদলাপুর’-এ চেহারার দিক থেকে নিজেকে খানিকটা পাল্টেছেন বরুণ। ‘এক ভিলেন’-এ সিদ্ধার্থ তা করেননি। চরিত্রের স্বার্থে ওজন বাড়িয়েছেন বরুণ। দাড়ি রেখেছেন। চুল কাটিয়েছেন এমন ভাবে যাতে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে। অকস্মাৎ স্ত্রী খুন হয়ে যাওয়ার পরের দৃশ্যে মেলোড্রামাটিক অভিনয় না করে শুধুমাত্র গলাটা একটু কাঁপিয়ে সংলাপ বলেছেন। যে ঘরানার অভিনয় তিনি এত দিন করে এসেছেন, তার থেকে এ সব অনেকটাই আলাদা।
কিন্তু এ সব রসদ থাকলেই কি বলা যায় যে বরুণের ৩৬০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে?
‘এক ভিলেন’য়ে সিদ্ধার্থর চাপও কম ছিল না। বরুণ তখনও ‘হাম্পটি শর্মা কী দুলহনিয়া’ নিয়ে ব্যস্ত। ফুরফুরে কমেডি করে হাত পাকাচ্ছেন। এ দিকে সিদ্ধার্থ চলে গিয়েছেন ‘হসি তো ফঁসি’ করতে। সেখানে তিনি অনেকটাই স্তিমিত। স্পটলাইটটা বেশি পড়েছে পরিণীতি চোপড়ার অভিনয়ে।
তার পর ‘এক ভিলেন’। গুমরোনো, গভীর অভিনয়। মুখে হাসি নেই। চোখে গভীর বেদনাবোধ। ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সিদ্ধার্থের চরিত্র নিজেকে জিজ্ঞেস করে ‘এতটা খারাপ হওয়াটাও কি জরুরি?’ ‘বদলাপুর’য়ের বরুণ কিন্তু এ প্রশ্ন করে না। তার কাছে প্রতিহিংসাই শেষ কথা।
ছবি মুক্তির পর সিদ্ধার্থের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু যে কথা তখন ওঠেনি, তা হল সিদ্ধার্থ যত কঠিন চরিত্রেই অভিনয় করুন না কেন, ছবিতে তাঁর বিপরীতে কিন্তু এমন কোনও দাপুটে অভিনেতা ছিলেন না, যাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। ‘এক ভিলেন’য়ে সিদ্ধার্থের সঙ্গে ছিলেন শ্রদ্ধা কপূর আর রীতেশ দেশমুখ। নিঃসন্দেহে রীতেশ নিজেও বেশ ভাল কাজ করেছিলেন এই ছবিতে। তবে রীতেশ কখনওই নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি নন!
সাজিদ নাদিয়াদওয়ালার ‘কিক’য়ে যাঁরা নওয়াজের ওই হাসি আর অভিনয় দেখে আশ্চর্য হয়েছেন, তাঁদের কাছে শ্রীরাম রাঘবনের ‘বদলাপুর’-এর নওয়াজ আরও বেশি প্রশংসার যোগ্য।
গোটা ছবি জুড়ে সাবলীল অভিনয় করে গিয়েছেন নওয়াজ। তা সে শরীরী ভাষাতেই হোক বা সংলাপ বলায়! ছোট্ট ছোট্ট নওয়াজি টাচ আর তাতেই কলকাতার হলেও নওয়াজ পর্দায় এলেই হাততালি পড়ছে। সংলাপ বললে দর্শক উল্লাস করছে!
‘এক ভিলেন’-এর সময় কিন্তু রীতেশের অভিনয়ে এ রকম কিছু হয়নি। আর সেখানেই বরুণের চ্যালেঞ্জটা বেড়ে যায়। এ রকম একজন তুখড় অভিনেতার পাশে অভিনয় করে যাওয়াটাই ঝক্কির ব্যাপার। এক চুল এদিক ওদিক হলেই দুই অভিনেতার মধ্যে বিশাল ফারাক ধরা পড়ে যাবে। দর্শক যখন একটা ছবি দেখেন, তখন কে বরুণ, কী তার ব্যাকগ্রাউন্ড, সে সব তো মাথায় রাখার কথা নয়। রঘু (বরুণের চরিত্রের নাম) কি লায়েক (নওয়াজের চরিত্র)-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে? সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয়। নওয়াজের ওই দাপুটে অভিনয়ের পাশে বরুণ যে মুখ থুবড়ে পড়ে যাননি— সেটাই তো বিশাল ব্যাপার। হয়তো কিছু কিছু জায়গায় একটু অভিব্যক্তিহীন লেগেছে বরুণকে। হয়তো বা ‘চিল ফ্যাক্টর’ আর অভিনয়ে পরিণতমনস্কতার অভাবও রয়েছে। নওয়াজের পাশে বলে সেটা আরও বেশি বোঝা যাচ্ছে।
প্রথমে মূলধারার ছবিতে নিজেকে ভাঙবেন। তার পর আবার নওয়াজের পাশে ত্রুটিহীন অভিনয় করবেন। সাতাশ বছরের বরুণের এতটা চাপ নেওয়াই যে বিশাল ব্যাপার। প্রথম কারণটা সিদ্ধার্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও দ্বিতীয়টা একান্তই বরুণের চ্যালেঞ্জ।
‘এক ভিলেন’-এর সময় সিদ্ধার্থকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল দু’টো ছবি করেই কেন ইমেজ ভাঙতে বসেছিলেন তিনি, তাঁর উত্তর ছিল, ‘‘দু’টো ছবিতে ইমেজ তৈরি হয় না। ‘এক ভিলেন’-এর চিত্রনাট্য পড়েই বুঝলাম যে চরিত্রটা আমাকে দেওয়া হয়েছে, সেটা অনেকটাই আলাদা। মনে হল এটা করতে পারলে বেশ ভাল হবে। ক্যানভাসটা বড় হয়ে যাবে। আমি ভাবলাম কী গ্যারান্টি যে রোম্যান্টিক ছবি করলেই সেটা হিট হবে? এখানে অন্তত লোকে বুঝবে যে আমি ভাল বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই। কারেক্ট টাইম বলে কিছু হয় না। পাঁচ বছর পর আমি এটা করলে ভাল হত, তা আমি মনে করি না।’’
তখনই আরও বলেছিলেন যে বাণিজ্যিক, অ-বাণিজ্যিক না ভেবে বিষয়ের পিছনে ছোটেন তিনি। আশা করেছিলেন ‘এক ভিলেন’ বক্স অফিসে ভাল করলে উনি প্রতিযোগিতায় এক ধাপ এগিয়ে যাবেন। প্রশ্ন তা হলে এটাই, ‘বদলাপুর’ মুক্তির পরে রসায়নটা একটু পাল্টে গেল কি?
উঠতি নায়িকাদের মধ্যে আলিয়া ভট্ট (‘হাইওয়ে’) আর শ্রদ্ধা কপূর (‘হায়দার’) ইতিমধ্যেই শক্তিশালী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘ফাইন্ডিং ফ্যানি’র পর দীপিকার ‘পিকু’র অভিনয় নিয়েও উত্তেজনা রয়েছে। আর নতুন নায়কেরা? নিজেদের ভেঙে গড়তে চাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে আসা তরুণ নায়কদের দুনিয়ায় এত দিন সংসার করছিলেন রণবীর কপূর (‘বরফি’), রণবীর সিংহ (‘লুটেরা’), অর্জুন কপূর (‘ফাইন্ডিং ফ্যানি’) আর সিদ্ধার্থ। সে দলে এখন নাম লিখিয়েছেন বরুণও।
সামনে বরুণের হাতে ‘এবিসিডি ২’ আর ‘ঢিসুম’। গান-নাচ, মারপিট কেন্দ্রিক মূলধারার ছবি। ‘বদলাপুর’-এ অভিনয়ের যে সুযোগ ছিল, তা এ ছবিতে বরুণ না-ও পেতে পারেন। কিন্তু সিদ্ধার্থের পরের ছবির নাম ‘ব্রাদার্স’। এটা ‘ওয়ারিয়র’ বলে এক ছবির অফিশিয়াল রিমেক। যে ছবির অভিনয়ের জন্য সেরা সহ-অভিনেতার অস্কার পুরস্কার এসেছিল ‘ওয়ারিয়র’-এর ঝুলিতে। সামনে মুক্তি পাবে অনুরাগ কশ্যপের ‘বম্বে ভেলভেট’। সেখানে রণবীর কপূর এক বক্সারের ভূমিকায়। যাঁরা ছবিটা দেখেছেন, তাঁদের কথায় পর্দায় রণবীর না কি বিধ্বংসী।
যে সিদ্ধার্থ ভেবেছিলেন ‘এক ভিলেন’ দিয়ে তাঁর প্রতিযোগীদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে যাবেন, তিনি কি এখন সেই দাবিটা আর করতে পারবেন? কেউ বলছেন সিদ্ধার্থকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে ম্যারাথনের প্রথম ল্যাপে এগিয়ে গিয়েছেন বরুণ।
তবে এখন যুদ্ধের প্রথম রাউন্ড। বিজয়ী ঘোষণার দেরি আছে।